সফল স্টার্টআপ
কৃষকদের পাশে দুই বন্ধুর ‘আইফার্মার’
গত সাড়ে তিন বছরে ১৯ জেলার ১৭ হাজার কৃষককে ঋণ দিয়েছে। শুধু তা–ই নয়, কৃষকের গবাদিপশু পালন ও শস্য উৎপাদনে প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যও ছয়টি বিভাগের ৯৬টি বাজারে বিক্রি করছে আইফার্মার।
দুই বন্ধু বড় হয়েছেন ঢাকায়। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। চাকরি করার সময়ই পরিকল্পনা করেন—নিজেরা কিছু করবেন। শুরুতে নগরের ছাদবাগান করে দেওয়ার ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামলেন। পুঁজি নিজেদের জমানো ৩০ লাখ টাকা, একটি কক্ষ আর একটি ল্যাপটপ। সাত মাস কাজ করার পর বুঝলেন বাগানের পরিকল্পনা দিয়ে বেশি দূর এগোনো যাবে না। পরিকল্পনা বদলে সরাসরি কৃষককে ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় সফলতার মুখ দেখলেন দুই বন্ধু ফাহাদ ইফাজ ও জামিল এম আকবর। তাঁদের গড়ে তোলা স্টার্টআপ ‘আইফার্মার’ গত সাড়ে তিন বছরে ১৯ জেলার ১৭ হাজার কৃষককে ঋণ দিয়েছে। শুধু তা–ই নয়, কৃষকের গবাদিপশু পালন ও শস্য উৎপাদনে প্রশিক্ষণ এবং পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যও ছয়টি বিভাগের ৯৬টি বাজারে বিক্রি করছে আইফার্মার। তাঁদের নিবন্ধিত কৃষকেরা সরাসরি ব্যাংকঋণও পেতে শুরু করেছেন।
আইফার্মারের গল্প শুনতে গত বুধবার রাজধানীর গুলশানে তাদের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় বেশ সাজানো–গোছানো অফিস। খোলামেলা পরিবেশ। নিচে কর্মীদের জন্য ক্যাফেটেরিয়া। দোতলায় কর্মীরা কাজ করছেন। পাশের একটি ছোট কক্ষে বড় টেবিলের দুই পাশে ল্যাপটপে কাজ করছিলেন আইফার্মারের দুই কান্ডারি ফাহাদ ও জামিল। অল্পক্ষণেই আড্ডা জমে উঠল।
এক ফাঁকে বলে নিই, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই এই দুই বন্ধু একটা অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনাবিষয়ক (ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট)
প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তখন তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন। তো পড়াশোনা শেষ করে ফাহাদ প্রথমে সুইস কন্ট্যাক্ট নামের বিদেশি একটি সংস্থায় যোগ দেন। তখন তিনি জেলায় জেলায় ঘুরে কৃষকের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করেন। পরে বিশ্বব্যাংকে চাকরি নেন। আড়াই বছর কাজ করার পর কেয়ার ইন্টারন্যাশনালের হয়ে মিয়ানমারে কৃষকদের নিয়ে কাজ করতে চলে যান। অন্যদিকে জামিল শুরুতে টাইগার আইটিতে যোগ দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ডিজিটাল ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রকল্পে কাজ করেন। পরে গ্রাফিক পিপলে যোগ দিয়ে বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন কোম্পানির প্রযুক্তিবিষয়ক সেবা দেওয়ার কাজ করতেন।
ফাহাদ বললেন, ‘কেয়ার ইন্টারন্যাশনালের হয়ে মিয়ানমার ও পরে কম্বোডিয়ায় কাজ করতে গিয়ে আমি দেখলাম, বাংলাদেশের মতো সেই দেশের কৃষকেরাও ঋণসহায়তা পেতে সমস্যায় পড়েন। তাঁদের উৎপাদিত পণ্যও চার–পাঁচ হাত ঘুরে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায়। সে কারণে কৃষকেরা পণ্যের সঠিক দামও পান না। তখনই আমার মাথায় কৃষকের জন্য কাজ করার বিষয়টি ঢুকে যায়। বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা কৃষকদের সক্ষমতা বাড়াতে প্রচুর টাকা ঢালছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।’
আরেকটি ঘটনা বললেন ফাহাদ। তখন তিনি চাকরি করেন। বললেন, ‘চুয়াডাঙ্গায় একজন কৃষকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কথার এক ফাঁকে কৃষক জানতে চাইলেন, আমরা হাঁসের খামারের জন্য অর্থায়ন করি কি না? তখন আমাদের প্রকল্পে হাঁসের খামারের জন্য ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। আমি পকেট থেকে ১৫ হাজার টাকা দিলাম। ফেরার সময় ভিজিটিং কার্ড দিয়ে এলাম। ঢাকায় ফেরার পর ঘটনাটি ভুলেও যাই। পাঁচ-সাত মাস পর সেই কৃষক আমাকে মোবাইলে ফোন করে বললেন, হাঁস চাষ করে মুনাফা হয়েছে। পুরো টাকা ফেরত দিতে চান, সঙ্গে তিন হাজার টাকা মুনাফা। টাকাটা আমি নিইনি। তবে আমার ভেতরে ভাবনাটা এসেছে, মাত্র ১৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে মুনাফা করেছেন। সেই মুনাফার ভাগও দিতে চান। তার মানে কিছু একটা ব্যবসা কিন্তু আছে।’
আইফার্মার আইডিয়াটা প্রথম ফাহাদের মাথাতেই আসে। তখন জামিল ঢাকায় আর ফাহাদ মিয়ানমারে। দুজন দুই দেশে, তাতে কী। প্রতিদিনই ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে কথা হতো দুই বন্ধুর। এবার পরিকল্পনা শেষে মাঠে নামার পালা। ২০১৮ সালের মার্চে জামিল চাকরি ছাড়লেন। ব্যবসার পুঁজি জোগাতে নিজের শখের গাড়িটাও বেচে দিলেন। বললেন, ‘আমার প্রথম গাড়ি। বিক্রি করতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। তারপরও বিক্রি করলাম। কারণ, আমরা নতুন কিছু করার জন্য মুখিয়ে ছিলাম।’
শুরুতে তাঁরা লালমনিরহাটের পাটগ্রামে যান। কৃষক ও খামারিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন। তারপর ৪০ জন খামারিকে একটি করে গরু কিনে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ জন্য ২০ লাখ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু টাকা আসবে কোথা থেকে। চিন্তায় পড়ে গেলেন দুই তরুণ। হাতে টাকা নেই। কী করা যায় ভাবতে ভাবতে দুই বন্ধু দুই-তিনটি ব্যাংকে গেলেন। ব্যাংক তাঁদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। তখন অনলাইনে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলেন ফাহাদ ও জামিল। দেখলেন, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে একাধিক স্টার্টআপ মানুষের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে কৃষকদের ঋণ দিয়েছে। সাহস পেলেন দুই উদ্যোক্তা। বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের কাছে তাঁদের পরিকল্পনা বললেন। পাশাপাশি এক বছরের মধ্যে ৪০ শতাংশ মুনাফাসহ মূল অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিলেন। কিন্তু বিশ্বাস করছিলেন না অনেকে।
ফাহাদ বললেন, ‘আমরা যখন পরিকল্পনাটি বলছিলাম, তখন সবাই এটিকে ডেসটিনির মতো কিছু বলে ভাবতে লাগলেন। তবে আমাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার ছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা যেহেতু টাকাপয়সা নিয়ে পালিয়ে যাব না, সেই বিশ্বাসে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন টাকা বিনিয়োগ করলেন।’
সেই টাকা নিয়ে পাটগ্রামে চলে গেলেন ফাহাদ ও জামিল। ৪০ জন খামারিকে ৪০টি গরু কিনে দিলেন হাট থেকে। প্রতিটি গরুর দাম পড়ল ৪২ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা গরুর রোগবালাই প্রতিরোধে টিকা ও গোখাদ্যের জন্য খামারিদের দিলেন। আর দেখভালের জন্য দুজনকে নিয়োগ দিলেন। ঢাকায় ফিরে পুরো প্রক্রিয়ার প্রযুক্তিগত বিষয় নিয়ে মনোযোগী হলেন এই দুই উদ্যোক্তা। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট তৈরি করলেন। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি কোম্পানির নিবন্ধন নিলেন।
প্রথম দফায় সফল হলেন ফাহাদ ও জামিল। এক বছরের মধ্যে সব গরু বিক্রি করে মুনাফাসহ মূল অর্থ ফেরত দিলেন খামারিরা। তার আগেই দ্বিতীয় ব্যাচে ১০০ জন কৃষককে চূড়ান্ত করেন। তাঁদের ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। পাশাপাশি গ্রিন ডেলটা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে গরুর বিমা করার উদ্যোগ নেন। তখন বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজন ছাড়া অন্যরাও বিনিয়োগে আগ্রহী হলেন।
ফাহাদ জানান, ‘আইফার্মারের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ২ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ ১২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। ইতিমধ্যে তাঁদের মুনাফাসহ ৯০ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। তবে শুরুতে বিনিয়োগকারীদের ৪০ শতাংশ মুনাফা দেওয়া হলেও এখন তা ১৭ শতাংশ। তবে ধীরে ধীরে আমরা ব্যাংকের মাধ্যমেই ঋণ দিতে চাই। কারণ, আমাদের মূল লক্ষ্য কৃষক। তাঁদের ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ দেওয়াটা সবচেয়ে সাশ্রয়ী।’
বর্তমানে আইফার্মারের নিবন্ধিত কৃষকের সংখ্যা ৬৪ হাজারের মতো। তাঁদের প্রত্যেকের ৬০ ধরনের তথ্য-উপাত্ত প্রতিষ্ঠানটির কাছে রয়েছে। সেটি ব্যবহার করেই মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক কৃষকদের ৯ শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে আইফার্মার ঋণ নেওয়া কৃষকের কাছ থেকে সার্ভিস চার্জ বাবদ ২ শতাংশ অর্থ পায়। ফাহাদ বললেন, ‘এনজিও থেকে ঋণ নিলে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ সুদ দিতে হয়। মহাজনি ঋণের সুদের হার আরও বেশি, ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। সেই হিসাবে আমাদের ঋণ কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী।’
করোনাকালের শুরুতে কৃষকেরা যখন পণ্য বিক্রি করতে সমস্যায় পড়েছিলেন, তখন আইফার্মার নতুন উদ্যোগ নেয়। তারা কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনে ঢাকায় পাইকারি বাজারে বিক্রি শুরু করে। বর্তমানে ১৯টি জেলার ৪০টি পয়েন্ট থেকে সবজি সংগ্রহ করে ৬টি বিভাগের ৯৬টি বাজারে সরবরাহ করে আইফার্মার। তাতে কৃষকেরা তাঁদের পণ্যের কিছুটা হলেও বাড়তি দাম পান।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে ফাহাদ বলেন, ‘আমরা কৃষকদের জন্য ওয়ান–স্টপ সলিউশন চালু করতে চাই। কারণ ঋণ, বীজ ও সার, পরামর্শ এবং বিক্রির জন্য আলাদা জায়গায় দৌড়াতে হয়। আমরা কৃষকদের মাথাব্যথা কমাতে চাই। তাঁদের পণ্যের উৎপাদন খরচ কমাতে চাই। কারণ, ১০ জন কৃষকের মধ্যে ৯ জনের সন্তানই ভবিষ্যতে কৃষিকাজে আসতে চান না। তাই কৃষকদের কাজকে সহজ করে তাঁদের সন্তানদের কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে জাতি হিসেবে বিপদে পড়ব।’
আইফার্মারে বর্তমানে স্থায়ী কর্মী ১২০ জন। খণ্ডকালীন ধরলে সংখ্যাটি ২০০-এর ওপরে। সম্প্রতি তাঁরা ২১ লাখ মার্কিন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছেন। সেই অর্থ প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ব্যয় করা হবে বলে জানালেন ফাহাদ।
এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আমরা আইফার্মারের দুই উদ্যোক্তার কথা শুনছিলাম। সময় ঘড়ি উঠতে তাড়া দিচ্ছে। জানতে চাইলাম নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ কী? জামিল বললেন, ‘সফলতার সহজ কোনো পথ নেই। মাঠে–ঘাটে দৌড়াতে হবে। দিনে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হবে।’