অর্থনীতির গেম চেঞ্জার–৪৪
আযীযুল হক ও ইসলামি ধারার ব্যাংক যেন একসূত্রে গাঁথা
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখন অর্থনীতিতে। ৫০ বছরে বাংলাদেশ নামের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হয়ে উঠেছে চমকে ভরা জাদুর বাক্স। সাহায্যনির্ভর বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত। তবে যাত্রাপথটা সহজ ছিল না। বড় ঝুঁকি নিয়ে অভিনব পথে এগিয়ে গেছেন আমাদের সাহসী উদ্যোক্তারা। এ সাফল্যের পেছনে আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ যেমন ছিলেন, আছেন নীতিনির্ধারকেরাও। মূলত অর্থনীতির এসব অগ্রনায়ক, পথ রচয়িতা ও স্বপ্নদ্রষ্টারাই ৫০ বছরে বিশ্বে বাংলাদেশকে বসিয়েছেন মর্যাদার আসনে।
আমরা বেছে নিয়েছি সেই নায়কদের মধ্যে ৫০ জনকে। আমাদের কাছে তারাই অর্থনীতির ‘গেম চেঞ্জার’।
দেশে ইসলামি ধারার ব্যাংকব্যবস্থা ও ব্যবসা এখন বেশ জনপ্রিয়। প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোও ইসলামি ধারার ব্যাংকে রূপান্তর হচ্ছে। দিনে দিনে বাড়ছে শরিয়াভিত্তিক আমানত ও ঋণের পরিমাণ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হওয়ায় প্রচলিত ধারার চেয়ে শরিয়া ব্যাংকিংয়ের প্রসারও হচ্ছে বেশি। এর শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদের পুঁজি ও দেশের কয়েকজন ব্যাংকার চাকরি ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন এই ব্যাংকে।
তাঁদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন এম আযীযুল হক। কাজ করতেন সোনালী ব্যাংকে। আর কদিন গেলেই তিনি ২৫ বছর চাকরি করার জন্য পুরো সুযোগ-সুবিধা পেতেন। সেসব ছেড়েই তিনি যোগ দিয়েছিলেন ইসলামী ব্যাংকে। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামি ধারার ব্যাংকিং ব্যবসায় শরিয়া নিশ্চিতের দায়িত্ব ছিলেন। ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর তিনি ইহজগৎ ত্যাগ করে চলে যান। আর ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্ব নেওয়ার আগে তিনি সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজে দীর্ঘ ১২ বছর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্ব পালন শেষে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ইসলামি ধারার প্রায় সব ব্যাংক ও প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর ইসলামি উইন্ডো ও শাখা নিয়েছে তাঁর পরামর্শ। এ জন্য এম আযীযুল হক ও শরিয়া ব্যাংকের নাম যেন একসূত্রে গেঁথে গেছে। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ছিলেন ব্যাংকগুলোর ইসলামি শরিয়া বোর্ডের দায়িত্বে। ছিলেন পূবালী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান।
যেভাবে শুরু
এম আযীযুল হক ছিলেন রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তা। ১৯৭৯ সালের ২২ নভেম্বর কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম খালেদ ও সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজের অধ্যক্ষ এম আযীযুল হকের নেতৃত্বে ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর ইসলামিক ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ’ গঠন করেন। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে এই ‘গ্রুপ’টি ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (বিবা) নামে পুনর্গঠিত হয়। আর তখন বিবার স্লোগান ছিল ‘বিবা টু ফাইট রিবা’। রিবা অর্থ সুদ। অর্থাৎ বিবার কাজ সুদের বিরুদ্ধে লড়াই।
ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পটভূমি নিয়ে ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বিস্তারিত লিখেছেন। তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা পরিচালক এ এস এম ফখরুল আহসান বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক ঘুরে বাংলাদেশে একই ধাঁচের ইসলামি ব্যাংকিং চালুর সুপারিশ করেন। তখন সরকারি ব্যাংকগুলোতে ইসলামি ব্যাংকিং চালুর আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান ও কর্মশালা হয়। ১৯৮২ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিবা বিভিন্ন ব্যাংকের ২১১ জন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমি, সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজ, জনতা ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও কৃষি ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষণ দেয়।
ইসলামী ব্যাংকের অনুমোদন
১৯৮০ সালে দেশে বেসরকারি খাতে ব্যাংক চালুর সিদ্ধান্ত হয়। মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক লশ্কর ও মফিজুর রহমানের নেতৃত্বে কয়েকজন উদ্যোক্তা বাংলাদেশে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ব্যাংক অব ঢাকা লিমিটেড’ নামে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য অনুমতি চেয়ে আবেদন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৮১ সালের ২৩ এপ্রিল সে আবেদনে প্রাথমিক অনাপত্তি দেয়। ওই সময়ে দেশে আরও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক চালুর অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কিন্তু ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় আট কোটি টাকার পরিশোধিত মূলধন সংগ্রহ বিলম্ব হওয়ায় কার্যক্রম চালুতে বিলম্ব হয়। পরে আইডিবিসহ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ১১টি ইসলামী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থা এবং সৌদি আরবের দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ইসলামী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের ৭০ ভাগ জোগান দেন। বাংলাদেশ সরকার দেয় ৫ ভাগ এবং ১৯ জন বাংলাদেশি ব্যক্তি, ৪টি বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান মিলে ১৫ ভাগ জোগান দেয়। বাকি ১০ ভাগ রাখা হয় পাবলিক শেয়ার হিসেবে। এভাবেই কার্যক্রম শুরু করে ইসলামী ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে প্রস্তাবিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ব্যাংক অব ঢাকা লিমিটেড’কে ইসলামি পদ্ধতিতে ব্যাংক ব্যবসা পরিচালনার জন্য ‘লেটার অব ইনটেন্ট’ দেয়। তবে ব্যাংকের কাজ শুরুর জন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। কারণ, তখন ব্যবস্থাপনা পরিচালক হওয়ার জন্য মহাব্যবস্থাপক ও তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তা হওয়ার শর্ত ছিল। নতুন ধারার ব্যাংক হওয়ায় তখন কেউ রাজি হয়নি। তখন সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজের অধ্যক্ষ এম আযীযুল হককে সামনে রেখে ইসলামী ব্যাংকের কাজ শুরু হয়। তিনি তখন সহকারী মহাব্যবস্থাপক। এ জন্য ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী হিসেবে তাঁকে নিয়োগের অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এম আযীযুল হক ১৯৮৩ সালের ১ মার্চ দেশের প্রথম ইসলামী ব্যাংকের প্রথম প্রধান নির্বাহীর ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব নেন।
ইসলামী ব্যাংকের উদ্বোধন
১৯৮৩ সালের ২৭ মার্চ ইসলামি ধারায় ব্যাংকিং লেনদেন পরিচালনার জন্য ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’–এর নামে বাংলাদেশ ব্যাংক লাইসেন্স ইস্যু করে। ১৯৮৩ সালের ৩০ মার্চ সকালে ব্যাংকের রেজিস্টার্ড অফিসে ৭৫ মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় রাজা ভবনের তৃতীয় তলার উত্তর পাশের হলরুমে অনানুষ্ঠানিকভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম ইসলামী ব্যাংকটির উদ্বোধন করা হয়। সেদিনই প্রথম শাখার প্রথম ব্যবস্থাপক হিসেবে অ্যাসিস্ট্যান্ট এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে রূপালী ব্যাংক নওয়াবপুর শাখার কর্মকর্তা মতিন উদ্দীন আহমদ বারো ভূঁইয়া যোগ দেন। পরে তিনি শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। সেদিনই ৪৯টি চলতি হিসাবে ৩৫ লাখ ১৩ হাজার ৫০৯ টাকা জমা হয়।
ইসলামী ব্যাংকের নামকরণ নিয়ে এম আযীযুল হক এক গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘লাইসেন্সের জন্য ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে যখন ফাইনালি মেমোরেন্ডাম আর্টিকেল যাচ্ছে, তখন তৎকালীন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের ভাইস চেয়ারম্যান মুফিজুর রহমান সাহেব বলেন, ‘হক সাহেব! এটা কোনো নাম হলো বা এত লম্বা নাম হবে কেন? ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামটা এভাবে দেন।’ আমি তাঁকে বললাম, নাম তো বোর্ডে অনুমোদন করাতে হবে। উনি বললেন, ‘বোর্ডে অনুমোদন করানোর দায়িত্ব আমার। আপনি এই নাম দেন।’ এভাবে আমি ‘ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড’ নাম দিয়ে আবেদন পাঠালাম এবং এই নামেই লাইসেন্স হলো।
আযীযুল হক ও শরিয়া ব্যাংক
আযীযুল হকের হাতে যাত্রা করা ইসলামী ব্যাংক এখন দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক। ২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা বদলের সময় এম আযীযুল হক ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান। তখন তাঁকেও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। অবশ্য এরপর তিনি পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন।
মৃত্যুকালে তিনি সেন্ট্রাল শরিয়া বোর্ডের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানের পাশাপাশি সিটি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, ঢাকা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, এবি ব্যাংক ও ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের শরিয়া সুপারভাইজরি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। দেশে এমন আর একজন ব্যাংকারকেও পাওয়া যায় না, যাঁর ছোঁয়া নিয়েছে এতগুলো ব্যাংক।