২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আনারস, কলা, পাটের সুতায় তৈরি তৌহিদের পণ্য যাচ্ছে ৩৯ দেশে

পরিবেশসম্মত গৃহসজ্জার পণ্য তৈরির জন্য ছয়টি কারখানা গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তা তৌহিদ বিন আবদুস সালাম। মাত্র ১৪ লাখ টাকা ও একজন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটিতে এখন কাজ করছেন ৪ হাজার ৭০০ কর্মী।

সিএইচপির তৈরি গৃহসজ্জার সামগ্রী
কোম্পানির সৌজন্যে

কলাগাছের খোল, আনারসের পাতা কিংবা পাটের আঁশ—চারপাশের পরিবেশ থেকে নেওয়া এসব উপকরণ থেকে তৈরি হয় সুতা। এরপর সেগুলো মেশানো হয় তুলা থেকে তৈরি (কটন) সুতার সঙ্গে। মিশ্রিত এসব সুতা দিয়ে পরবর্তী সময়ে বানানো হয় গৃহসজ্জার বিভিন্ন পণ্য। এ কাজে আরও ব্যবহার হয় বাঁশ, বেত, খেজুরপাতা, তালের আঁশ, ধঞ্চে, কচুরিপানা ও ভুট্টার খোসার মতো অনেক উপকরণ।

শতরঞ্জি, ঝুড়ি, শপিং ব্যাগ, টি-শার্ট, কুশন কাভার থেকে শুরু করে রান্নাঘর, পোষা প্রাণী ও বাগানসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উপকরণ বানানো হয় এই প্রক্রিয়ায়। উৎপাদিত পণ্যের প্রায় সবই রপ্তানি হয় জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, স্পেনসহ বিশ্বের ৩৯টি দেশে। ক্রেতাদের মধে৵ রয়েছে িকক্‌, জারা ও ওয়ালমার্টের মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান।

প্রায় দেড় দশক আগে টেকসই উপায়ে পণ্য তৈরির জন্য ক্ল্যাসিক্যাল হ্যান্ডমেড প্রোডাক্টস বিডি লিমিটেড (সিএইচপি) নামে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন উদ্যোক্তা মো. তৌহিদ বিন আবদুস সালাম। শুরুতে বড় বায়িং হাউসে চাকরি ও শিক্ষকতা করলেও পরে তা ছেড়ে নাম লেখান উদ্যোক্তা হিসেবে। উদ্দেশ্য ছিল নিম্নবিত্ত মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যাবস্থা করা।

মাত্র ১৪ লাখ টাকা ও একজন কর্মী নিয়ে শুরু করা তাঁর সেই উদ্যোগে এখন পর্যন্ত বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। আর প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে কাজ করছেন ৪ হাজার ৭০০ কর্মী। এঁদের মধ্যে প্রায় ৮৬ শতাংশই নারী। সম্প্রতি রাজধানীর মতিঝিলে সিএইচপির কার্যালয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌহিদ বিন আবদুস সালামের সঙ্গে।

পড়াশোনা ও চাকরি

তৌহিদ বিন আবদুস সালামের পৈতৃক বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায়। তবে জন্ম ও বেড়ে ওঠা রাজধানীর মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে। মা চেয়েছিলেন ছেলে চিকিৎসক হবেন। আর বাবা চেয়েছিলেন ছেলে হবেন পোশাকের ডিজাইনার। চিকিৎসক না হলেও ফ্যাশন ডিজাইনে স্নাতক করে বাবার ইচ্ছে পূরণ করেন তিনি।

ঠিক উদ্যোক্তা হবেন—এমন ইচ্ছে শুরু থেকে ছিল না তৌহিদের। উচ্চমাধ্যমিক শেষে ২০০০ সালে ভর্তি হন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে (বিইউএফটি)। সেখানে ফ্যাশন ডিজাইন বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। তৃতীয় বর্ষে থাকা অবস্থায় নেদারল্যান্ডসের একটি বায়িং হাউসে বিপণন বিভাগের চাকরি হয় তৌহিদের। স্নাতক শেষ করে ওই কাজের পাশাপাশি দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন প্রভাষক ছিলেন।

উদ্যোগ শুরুর কথা

২০০৭ সালের মার্চ মাসের কথা। সহকর্মীদের সঙ্গে নীলফামারীতে ঘুরতে যান তৌহিদ। এ সময় েজলার ডিমলা উপজেলায় ঘোরার সময় স্থানীয় এক নারীকে পাথর ভাঙতে দেখেন। কথা বলে জানতে পারেন, সারা দিন কাজ করে মাত্র ৪০ টাকা মজুরি পান ওই নারী। টাকার অভাবে ঠিকমতো খেতেও পারতেন না ওই নারী। এই ঘটনা তৌহিদের মনে দাগ কাটে। নীলফামারী থেকে ফিরে তিন মাসের মাথায় বাইং হাউসের চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। নিজের জমানো ১৪ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় নামেন

মতিঝিলে ছোট একটি কক্ষ ভাড়া করে ও একজন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় তৌহিদের উদ্যোগের। ২০০৭ সালের নভেম্বরে নীলফামারী ও রংপুরে তিনটি তাঁতের কারখানা স্থাপন করেন তিনি। প্রতিটি কারখানায় ৩০ জন করে কর্মী নিয়োগ দেন। শুরু থেকেই তাঁর লক্ষ্য ছিল রপ্তানির। এ জন্য কারখানা স্থাপনের দুই মাসের মাথায় নিজেদের বানানো শতরঞ্জি নিয়ে জার্মানিতে একটি প্রদশ৴নীতে অংশ নেন। সেখানে ক্রেতারা তাদের পণ্য বেশ পছন্দ করেন।

পরে দেশে ফিরে ক্ল্যাসিক্যাল হ্যান্ডমেড প্রোডাক্টস (বিডি) নামে কোম্পানি নিবন্ধন করেন। ২০০৮ সালের মার্চে জার্মানির বস্ত্র কোম্পানি কিক প্রায় ৮৬ লাখ টাকায় এক লাখ পিছ শতরঞ্জির ক্রয়াদেশ দেয়। এর পর থেকে ব্যবসার পরিসর বাড়তে থাকে তাঁর। 

নীলফামারীর হাজীগঞ্জে সিএইচপির একটি কারখানায় পণ্য তৈরি করছেন নারী কর্মীরা
কোম্পানির সৌজন্যে

ব্যবসার পরিসর বেড়েছে

শতরঞ্জির প্রথম চালানের পর সিএইচপির পণ্যের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়। ২০১০ সালে শতরঞ্জির পাশাপাশি ঝুড়ি তৈরি শুরু করেন তিনি। এর প্রধান কাঁচামাল বাঁশ, বেত, পাট, তালপাতা, কাশফুল গাছ ও হোগলাপাতা। স্বল্প সময়ের মধ্যে ঝুড়ির চাহিদাও বেড়ে যায়। তৌহিদ জানান, ওই সময় প্রতি মাসে ইউরোপে পৃথকভাবে পাঁচ কনটেইনার করে ঝুড়ি ও শতরঞ্জি রপ্তানি হতো।

পর্যায়ক্রমে লন্ড্রি ব্যাগ, পাপোশ, প্লেসম্যাট, কার্পেট, মোড়া, চেয়ার, ল্যাম্পশেড, শপিং ব্যাগসহ টেবিল, রান্নাঘর, পোশা প্রাণীর ঘর ও বাগানসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গৃহসজ্জার উপকরণ বানাতে শুরু করে সিএইচপি। তৌহিদ বলেন, পাপোশ থেকে শুরু করে বিছানার কুশন পর্যন্ত একটি ঘরের প্রতিটি জায়গায় সাজসজ্জার জন্য আমরা পণ্য তৈরি করছি।

পাশাপাশি স্পা পণ্য, পেপার বক্স ও মেটাল বক্সের মতো উপকরণও রয়েছে এ তালিকায়। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের রিসাইকেল পণ্য দিয়ে নতুন পণ্য তৈরি করছেন তৌহিদ। যেমন প্লাস্টিক বোতল থেকে সুতা বানিয়ে ঝুড়ি তৈরি করছেন। আবার পোশাক কারখানার ঝুট কাপড় থেকে পাওয়া সুতা ব্যবহার হয় অন্য পণ্য তৈরিতে।

তিন জেলায় ছয় কারখানা

বর্তমানে নীলফামারী, বগুড়া ও রংপুরে সিএইচপির ছয়টি কারখানা রয়েছে। তৌহিদ জানান, কারখানাগুলোতে ২৮৩ ধরনের পণ্য তৈরি হয়। গত বছর এসব পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল প্রায় ১ কোটি ১১ লাখ মার্কিন ডলার বা প্রায় ১১০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৯৯ দশমিক ৪৫ টাকা ধরে)।

তৌহিদ বলেন, টেকসই উপকরণ, উন্নত কর্মপরিবেশ, পণ্যের গুণগত মান ও সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা—এই চারটি বিষয় আমি সব সময় মেনে চলি। অন্যদিকে ফ্যাশন ডিজাইনে পড়ার কারণে পণ্যের রং, গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড, পরিচালনব্যবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ছিল। এসব কারণে ব্যবসার উদ্যোগকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে।

বর্তমানে ১৭টি দেশি-বিদেশি সনদ রয়েছে সিএইচপির। এ ছাড়া হস্তশিল্পজাত পণ্য রপ্তানি শ্রেণিতে একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে সিএইচপি। পুরস্কারের ঝুড়িতে রয়েছে রাষ্ট্রপতি শিল্প পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু শিল্প পুরস্কার, এসএমই পুরস্কার, এইচএসবিসি এক্সপোর্ট এক্সিলেন্স পুরস্কার ও বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনকারী পুরস্কার।

দেশে অনলাইনে পণ্য বিক্রি

বর্তমানে রপ্তানির পাশাপাশি দেশেও অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছে সিএইচপি। পাশাপাশি জাতীয় এসএমই মেলাসহ কিছু অনুষ্ঠানে তাদের পণ্য বিক্রি হয়। এ ছাড়া ভবিষ্যতে নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র খোলারও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তৌহিদ।

রপ্তানিতে নিজের অবস্থান আরও মজবুত করতে চান তিনি। তৌহিদ জানান, বিদেশে নিজেদের পণ্যের সরাসরি ব্র্যান্ডিং করবেন। এ জন্য ইতিমধ্যে ইউরোপে নথিপত্র তৈরি প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। পাশাপাশি ভারত ও শ্রীলঙ্কাতে স্থানীয়ভাবে এসব পণ্যের কাঁচামাল উৎপাদন ও রপ্তানির পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।

চ্যালেঞ্জ কী

করোনার সময় বেশ চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয়েছিল তৌহিদকে। ওই সময় তাঁর ৮ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়। এ ছাড়া খরচ বাঁচাতে গুলশান থেকে মতিঝিলে সরিয়ে আনেন কার্যালয়। করোনার সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠলেও এখনো কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি তিনি।

তৌহিদ জানান, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় কম বেতনে এখন হস্তশিল্পে কাজের জন্য খুব বেশি কর্মী পাওয়া যায় না। তাই দক্ষ শ্রমিক পাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ডলার ও জ্বালানি–সংকটও প্রভাব ফেলেছে ব্যবসায়। তৌহিদ বলেন, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। তাতে উৎপাদন খরচও বাড়ছে। বিদ্যুতের টেকসই উৎস হিসেবে আমরা সৌর প্যানেল বসানোর চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু ডলার–সংকটের কারণে যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খুলতে পারছি না

তৌহিদ বলেন, ‘সরবরাহ ও যাতায়াত–সুবিধার কথা চিন্তা করে সবাই ঢাকা-চট্টগ্রামকেন্দ্রিক কারখানা করতে চান। আর আমি কারখানা নিয়ে গেছি গ্রামে, দরিদ্র মানুষের কাছে। তাতে তাঁরা পরিবারের সঙ্গে নিজ বাড়িতে থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারছেন। এতে তাঁদের অর্থও সাশ্রয় হয় অনেক।’

অন্যদিকে বস্ত্র খাতের জন্য টেকসই উপায়ে কলাগাছ, আনারস বা পাটের আঁশের মতো সুতার ব্যবহার বাড়াচ্ছি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে এসব পণ্যের বেশ চাহিদা রয়েছে। এতে রপ্তানি বহুমুখীকরণের পাশাপাশি কার্বন ফুটপ্রিন্টও কমছে।