২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

৩০০ টাকা দিয়ে শুরু, এখন তাঁর ব্যবসা হাজার কোটি টাকার

১৯৭৭ সালে মাত্র ৩০০ টাকা পুঁজি দিয়ে সবজির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। সেই ব্যবসা থেকে আজ তাঁর ব্যবসার আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। সফল এই উদে৵াক্তা হলেন খুলনার ফুলতলার মো. ফিরোজ আহমেদ।

মো. ফিরোজ আহমেদ
প্রথম আলো

১৯৭৭ সালে মাত্র ৩০০ টাকা পুঁজি দিয়ে সবজির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। সেই ব্যবসা থেকে আজ তাঁর ব্যবসার আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। আমরা বলছি খুলনার ফুলতলা উপজেলার মো. ফিরোজ আহমেদের কথা।

ফিরোজ আহমেদের পাটকল ও ট্যানারিতে এখন প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করেন। ফুলতলার উত্তরডিহিতে অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহৎ ট্যানারি সুপারেক্স লেদার লিমিটেড ও সুপার জুট মিলের মালিক তিনি। খুলনা এলাকায় তিনি একজন অনুসরণীয় উদ্যোক্তা। এলাকাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ির এলাকা হিসেবে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি দক্ষিণডিহি গ্রামে।

এবার ফিরোজ আহমেদের শুরুর গল্পটা শুরু করা যাক। স্বাধীনতার পরপর ফিরোজ আহমেদের বাবা আবদুল খালেক ভূঁইয়া খুলনা টোব্যাকোতে তামাকশ্রমিকের কাজ করতেন। তাঁর পাঁচ ছেলের মধ্যে ফিরোজ আহমেদ মেজ। বিরাট সংসারের খরচ টানা আবদুল খালেক ভূঁইয়ার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তাই খেয়ে, না খেয়ে দিন কাটত পরিবারটির। বছরে একটির বেশি জামা মিলত না কারও।

প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলডব্লিউজির সনদ পেলে আমাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তখন আমরা সরাসরি অ্যাডিডাস, পুমা ও গুচির মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর কাছে সরাসরি প্রক্রিয়াজাত চামড়া বিক্রি করতে পারব। এসব কোম্পানি পরিবেশবান্ধব ট্যানারি ছাড়া চামড়া কেনে না।’
ফিরোজ আহমেদ

১৯৭৭ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় নানাবাড়ির জমি বিক্রির টাকা থেকে ৩০০ টাকা নিয়ে ফিরোজ আহমেদ ও তাঁর বড় ভাই ফেরদৌস ভূঁইয়া ফুলতলা বাজারের সড়কের পাশে শাকসবজি বিক্রি করতে শুরু করেন। বয়স কম হওয়ায় ফিরোজ আহমেদ সবজি নামানো-ওঠানোর কাজই করতেন। কয়েক বছর পর সবজির ব্যবসার লাভের টাকা তাঁরা কাঠের ব্যবসায় খাটান। কাঠের ব্যবসায় লাভের মুখ দেখেন ফিরোজ আহমেদ। এভাবেই চলে তাঁদের টিকে থাকার সংগ্রাম। ধীরে ধীরে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য আসতে থাকে।

১৯৮৮ সালে ৮০ হাজার টাকায় ফুলতলায় একটি ইটের ভাটা লিজ নেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি ফিরোজ আহমেদকে। দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। খুলনায় তাঁদের সুপার ব্রিকস নামের প্রতিষ্ঠানটির বেশ নামডাক হয়। সেটি এখন তাঁর বড় ভাই দেখেন।

ফিরোজ আহমেদ ২০০৬ সালে খুলনার ফুলতলা বাজারের পাশে প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা খরচ করে সুপার জুট মিল নামের একটা পাটকল স্থাপন করেন। পাটকলেও তিনি সফল হন। সেখানে এখন প্রায় এক হাজার শ্রমিক কাজ করেন।

সম্প্রতি খুলনার ফুলতলার সুপারেক্স লেদার লিমিটেডের কারখানায় বসে কথা হয় ফিরোজ আহমেদের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলো কে নিজের জীবনের গল্প শুনিয়েছেন। ৫৮ বছর বয়সী ফিরোজ আহমেদ প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।

ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘বাবার অল্প মজুরিতে সংসার চলত না। বাধ্য হয়ে সবজির ব্যবসা করেছি। রাতে ইটভাটায় শ্রমিকদের সঙ্গে ঘুমিয়েছি। জীবনে এত দূর এসেছি সততার মাধ্যমে এবং পরিশ্রম করে। আমি শ্রমিকদের কখনো ঠকাইনি। কারণ, প্রথম জীবনে আমি নিজে শ্রমিকের মতো কাজ করেছি।’

দেশের বৃহত্তম ট্যানারি সুপারেক্স লেদার

পাটকলের সাফল্যে ফিরোজ আহমেদ চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ২০১৬ সালে তিনি খুলনার ফুলতলা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম উত্তরডিহিতে সুপারেক্স লেদার লিমিটেড নামে পরিবেশবান্ধব ট্যানারি প্রতিষ্ঠা করেন। এতে বিনিয়োগ করেন প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। এই কারখানার দৈনিক চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সক্ষমতা প্রায় ৮০ হাজার বর্গফুট। কারখানাটিতে এক দিনে তিন হাজার গরু ও দুই হাজার ছাগলের কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব। এটি দেশের বৃহত্তম ট্যানারিগুলোর একটি বলে দাবি ফিরোজ আহমেদের। এক একর জায়গা জুড়ে করা হয়েছে ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি)।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ৪০ একরের কারখানা এলাকার প্রায় ৮০ শতাংশই আম, জাম, কাঁঠাল, কতবেল, নারকেলসহ নানা ধরনের গাছগাছালিতে ভরপুর। গাছ লাগানো হয়েছে প্রায় এক হাজার। কারখানা ভবনটি লাল সিরামিক ইটের, দেখতে যেন সবুজের মধ্যে লালগালিচা।

দেশের বৃহত্তম ট্যানারি সুপারেক্স লেদার

কারখানার ভেতরে ঢুকতেই চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ শেড। এই শেডের আয়তন প্রায় ৪ লাখ ২৫ হাজার বর্গফুট। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে শুরু করে ‘ফিনিশড’ চামড়ায় পরিণত করা, সবই সেখানে হয়। পাশেই কাঁচা চামড়ার গুদাম। গুদাম পেরোলেই কাঁচা চামড়ার হিমাগার। পুরো কারখানাটি চলছে ইতালীয় যন্ত্রপাতিতে। 

বিদেশি ক্রেতাদের জন্য কারখানা এলাকায় ডরমিটরি তৈরি করা হয়েছে। আছে ক্যানটিনও। সেখানে গিয়ে দেখা মিলল পর্তুগালের সিমাকা নামের এক প্রতিষ্ঠানের ক্রেতা ফার্নান্দো বহনেনবার্গারের সঙ্গে।

তিনি তাঁদের চামড়ার অর্ডারটি কীভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে, তা সরেজমিনে দেখতে এসেছেন। তিনি প্রায়ই খুলনায় আসেন। ফার্নান্দো বহনেনবার্গার প্রথম আলোকে জানান, বাংলাদেশে অনেক কারখানায় তিনি পরিদর্শন করেছেন, কিন্তু এমন পরিবেশবান্ধব কারখানা তিনি খুব কমই দেখেছেন।

পরিবেশবান্ধব সনদের অপেক্ষায়

ইউরোপ-আমেরিকায় যেসব কারখানা চামড়া রপ্তানি করে, সেসব কারখানাকে আন্তর্জাতিক সংগঠন লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ নিতে হয়। দেশে হাতেগোণা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এ সনদ পেয়েছে। সুপারেক্স লেদার লিমিটেডও এই সনদের জন্য আবেদন করেছে। আগামী মাসে ওই সংগঠনের একটি প্রতিনিধিদল কারখানা পরিদর্শনে উত্তরডিহিতে আসবে। জানা গেছে, পরিদর্শনে আসা দলটি কারখানা দেখে সন্তুষ্ঠ হলে দুই–এক মাসের মধ্যে সনদ মিলতে পারে। এই সনদ পাওয়ার অন্যতম শর্ত হলো, কারখানার নিজস্ব ইটিপি থাকতে হবে।

এ বিষয়ে ফিরোজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলডব্লিউজির সনদ পেলে আমাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না। তখন আমরা সরাসরি অ্যাডিডাস, পুমা ও গুচির মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর কাছে সরাসরি প্রক্রিয়াজাত চামড়া বিক্রি করতে পারব। এসব কোম্পানি পরিবেশবান্ধব ট্যানারি ছাড়া চামড়া কেনে না।’

ফিরোজ আহমেদ জানান, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সুপারেক্স লেদারের রপ্তানি কমেছে। করোনার আগে প্রতি মাসে ১০-১২ লাখ বর্গফুট চামড়া রপ্তানি হতো। তা কমে ২-৩ লাখ বর্গফুটে নেমে এসেছে। সুপারেক্স পর্তুগাল, জার্মানি, ইতালি ও জাপানে চামড়া রপ্তানি করে থাকে।