পাটপণ্য নিয়ে বিশ্ববাজারে অপরাজেয়
ইন্ট্রো–আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার-২০২৩-এ রপ্তানিশিল্প শ্রেণিতে সেরা উদ্যোক্তা হয়েছেন অপরাজেয় লিমিটেডের কাজী মো. মনির হোসেন ও মুনিয়া জামান। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠান পাটের তৈরি ব্যাগ, হোগলাপাতা, শণের তৈরি বিভিন্ন পণ্য বিশ্বের ২৬টি দেশে রপ্তানি করছে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের সকাল। টেলিভিশনে সাভারের রানা প্লাজা ধসের কথা শুনে উদ্ধারের জন্য ছুটে যান অসংখ্য তরুণ। সেই তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের কয়েকজন মিলে পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে ‘অপরাজেয়’ নামে ছোট একটি কারখানা গড়ে তোলেন। সেই দলের সমন্বয়ক ছিলেন কাজী মো. মনির হোসেন।
রানা প্লাজা ধসের উদ্ধারকাজ শেষে উদ্ধার সরঞ্জাম কেনার তহবিল থেকে বেঁচে যাওয়া ১ লাখ ৫ হাজার টাকা থেকে সামাজিক উদ্যোগ শুরু করেন কাজী মো. মনির হোসেন ও তাঁর বন্ধুরা। রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাজের জন্য ভালো পরিবেশ ও ভালো মজুরির লক্ষ্যেই অপরাজেয় লিমিটেড নামের কারখানা গড়ে তোলেন তাঁরা। ২৫ জন কর্মী নিয়ে সেই কারখানায় পাটের ব্যাগ তৈরি হতো।
উদ্যোগটিকে টেকসই করতে ‘সংকলন বাংলাদেশ’ নামে একটি ট্রাস্ট হয়। এই ট্রাস্টের ট্রাস্টি ৯ জন—কাজী মো. মনির হোসেন, খুশি কবির, আক্কু চৌধুরী ও সামী আল-ইসলাম ছাড়া বাকি পাঁচজন রানা প্লাজায় আহত শ্রমিক। ট্রাস্টের মাধ্যমেই ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হয় অপরাজেয় নামের ব্যাগ তৈরির কারখানা।
৫০টি পাটের ব্যাগে শুরু
‘নারীপক্ষ’ নামের একটি এনজিওর জন্য ৫০টি পাটের ব্যাগ তৈরির মাধ্যমে শুরু হয় অপরাজেয়র পথচলা। শুরু করার মাত্র চার মাসের মধ্যে দেশি ক্রয়াদেশের পাশাপাশি স্বল্প পরিমাণে শুরু হয় রপ্তানি। পরের বছর প্রতিষ্ঠানের আয় দিয়ে চালু করা হয় ‘সংকলন পাঠশালা’ নামে একটি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। সংকলন পাঠশালার ২৪৫ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই ছিল রানা প্লাজায় আহত ও অন্য পোশাকশ্রমিকদের সন্তান। ২০১৫ সালে এক অগ্নিদুর্ঘটনায় কারখানা পুড়ে ২৭ লাখ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। তহবিল-সংকট ও অন্যান্য কারণে ২০১৬ সালে বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায়। একই বছর সংকলন বাংলাদেশ ট্রাস্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
পরে ২০১৮ সালে ব্যক্তি বিনিয়োগে ‘অপরাজেয় লিমিটেড’ নামে শতভাগ রপ্তানিমুখী পাটপণ্য ও হস্তশিল্প উৎপাদন কারখানা চালু করেন কাজী মো. মনির হোসেন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠান পাটের তৈরি ব্যাগ, হোগলাপাতা, শণের তৈরি বিভিন্ন পণ্য বিশ্বের ২৬টি দেশে রপ্তানি করছে। মনির বলেন, বর্তমানে দুটি উৎপাদন ইউনিটে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২৪০। এর বাইরেও হস্তপণ্য তৈরির জন্য বগুড়া, রংপুর, নোয়াখালীতে চুক্তিভিত্তিতে কাজ করছেন অসংখ্য নারী।
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
বর্তমানে ইউরোপের নামকরা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের জন্য পণ্য তৈরি করছে অপরাজেয়। কাজী মো. মনির হোসেন বলেন, ‘গতানুগতিক পদ্ধতিতে ব্যবসা পরিচালনা আর মুনাফা করা অপরাজেয়র লক্ষ্য নয়। আমরা একটি টেকসই পরিচালন পদ্ধতি তৈরিতে কাজ করছি, যেখানে শ্রমিকের অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা আর মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনই প্রাধান্য পায়।’
কাজী মো. মনির হোসেন আরও বলেন, ‘দেশে আমরাই একমাত্র হস্তশিল্প উৎপাদক প্রতিষ্ঠান, যারা পোশাকশ্রমিকদের জন্য সরকার-নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরিকাঠামো বাস্তবায়ন করেছি। প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন সহায়ক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষার খরচ, প্রতিবন্ধী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ ভাতা, ভর্তুকি মূল্যে রেশন সরবরাহ অন্যতম।’
বৈশ্বিক ক্রেতাদের শর্ত, কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা ও শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করতে ইতিমধ্যে অপরাজেয় সেডেক্সসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সনদ পেয়েছে। এ ছাড়া গ্লোবাল রিসাইকেল স্ট্যান্ডার্ড, বেটার কটন ইনিশিয়েটিভের মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মের সদস্য হয়েছে অপরাজেয়।
কালিন্দীর চমক
দেশের বাজারে মানসম্পন্ন পাটপণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতের ঘাটতির কথা বিবেচনায় নেন কাজী মো. মনির হোসেন ও তাঁর সহধর্মিণী মুনিয়া জামান। মুনিয়া জামান ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ মেডিকেলের ইমার্জেন্সি অ্যান্ড ক্যাজুয়ালটি বিভাগের প্রশাসনিক পদে কাজ করেন। পরবর্তী সময়ে চাকরিকে বিদায় জানান। ২০২১ সালে ‘কালিন্দী’ নামে একটি দেশি ব্যাগের ব্র্যান্ড চালু করেন। কালিন্দীর সব পণ্য অপরাজেয় কারখানার অব্যবহৃত উপকরণ থেকে তৈরি হয়।
কালিন্দী পপআপ স্টোর ও অনলাইন থেকে বর্তমানে মাসে দেড় হাজারের বেশি ব্যাগ বিক্রি হচ্ছে। মুনিয়া জানান, ‘শুরুতে শুধু পাটের ব্যাগ তৈরি করলেও বর্তমানে কালিন্দী চামড়ার ব্যাগও বানাচ্ছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ও গ্রাহকের চাহিদার কথা বিবেচনায় নিয়ে আমরা কালিন্দীর মাধ্যমে ফ্যাশননির্ভর ব্যাগ ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য পণ্য উৎপাদন শুরু করি। উন্নত কাঁচামাল ব্যবহার করে পণ্যের দাম কীভাবে ক্রেতার নাগালের মধ্যে রাখা যায়, সেই চেষ্টাই করছে কালিন্দী। এ ছাড়া কালিন্দীর সব ব্যাগের নামকরণ করা হয় নদীর নামে। কালিন্দীর ওয়েবসাইটে প্রতিটি পণ্যের বর্ণনার সঙ্গে আমরা একটি করে নদীর বিস্তারিত যুক্ত করছি। এতে ক্রেতারা দেশের নদীগুলোর সঙ্গে সহজেই পরিচিত হতে পারছেন।
বাজার তৈরির সুযোগ
উন্নত বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ হওয়ায় পাটপণ্যের বাজার বাড়ছে। এ ছাড়া করোনার পর মানুষ আরও বেশি পরিবেশসচেতন হয়েছে। ফলে পরিবেশবান্ধব পণ্যের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। পাটের ব্যাগ ও হস্তশিল্পের বর্তমান বৈশ্বিক বাজার প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের। গ্লোবাল মার্কেট ইনসাইটসের ভাষ্যে, ২০৩২ সালে বিশ্বের পাট ও পাটজাত পণ্যের বাজার হবে প্রায় ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের।
কাজী মো. মনির হোসেন বলেন, ‘যেসব সুপারমার্কেট আগে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার করত, এখন তারা পাটের ব্যাগ ব্যবহার শুরু করছে। আমরা এমন বেশ কয়েকটি সুপারমার্কেটের সঙ্গে কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, আগামী দুই বছরে আমাদের বার্ষিক রপ্তানি ১ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে।’
সম্মাননা
২০২৪ সালে হস্তশিল্পজাত পণ্য শ্রেণিতে অপরাজেয় লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. মনির হোসেন সিআইপি নির্বাচিত হয়েছেন।