হাজার থেকে শতকোটি টাকার ব্যবসা রাজা গ্রুপের
মাত্র ২ হাজার ২৫০ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় নেমেছিলেন খোন্দকার আবদুর রাজ্জাক ওরফে রাজা। ১৯৫৬ সালে বগুড়া নিউমার্কেটে কাঠের ছোট একটা দোকানে শুরু করেছিলেন ছিট কাপড়ের ব্যবসা। ট্রেনে চড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট হয়ে যমুনা পাড়ি দিয়ে রাজধানীর ইসলামপুর থেকে শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, স্যুটের কাপড় এনে খুচরায় বিক্রি করতেন। দোকানের নাম দেন ‘রাজা ক্লথ স্টোর’। অল্পদিনেই সাড়া ফেলে প্রতিষ্ঠানটি। খুচরার পাশাপাশি পাইকারি ব্যবসা শুরু করেন। অল্প দিনেই সুনাম ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের জেলায়।
১৯৬৫ সালে বগুড়া নিউমার্কেটে রাজা ক্লথ স্টোরের দোকানের সংখ্যা বেড়ে হয় ৭। ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। ছিট কাপড়ের পাশাপাশি মেয়েদের পোশাক, পর্দার কাপড়, পাঞ্জাবিসহ অন্যান্য পোশাকের ব্যবসাও শুরু করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বগুড়া নিউমার্কেট পুড়িয়ে দেওয়া হলে আবদুল রাজ্জাকের সব দোকানও পুড়ে যায়। যুদ্ধের পর আবার শূন্য হাতে শুরু করেন ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধ। ১৯৭২ সালে বগুড়া বিসিক চালু হলে সেখানে গড়ে তোলেন শর্ষে তেলের কারখানা। ১২টি ঘানি দিয়ে শুরু হয় রাজা অয়েল মিলের যাত্রা। শুরুতে শর্ষের তেলের ব্যবসা ভালোই চলছিল। পরে এ ব্যবসায় বিপর্যয় দেখা দিলে লোকসানের ধাক্কা কমাতে কারখানাটি ভাড়ায় দেন। ১৯৯৬ সালে খোন্দকার আবদুর রাজ্জাক মারা যান। ব্যবসার হাল ধরেন তাঁর বড় ছেলে খোন্দকার মেজবাহুল হক। এরপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে লোকসানি রাজা গ্রুপকে তিনি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপ দেন। মিজবাহুলের হাত ধরেই রাজা গ্রুপে এখন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬। ছিট কাপড়ের দোকানের পাশাপাশি, শর্ষের তেল, সিএনজি ফিলিংস্টেশন, পেপার মিল, ইটভাটা এবং ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এখন প্রতিষ্ঠানটি। নতুন আরও শিল্প ইউনিট স্থাপনের জন্য বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কের পাশে কেনা হয়েছে ১০ বিঘা জমি। রাজা গ্রুপের ব্যবসার পুঁজি এখন ২০০ কোটি টাকার ওপরে। প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১ হাজার ১০০ মানুষের।
শুরুর গল্প
খোন্দকার আবদুর রাজ্জাকের হাত ধরেই শুরু হয় প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা। আবদুর রাজ্জাকের বাবা খোন্দকার বেলাল উদ্দিন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান কাস্টমসের কর্মকর্তা। ১৯৫৫ সালে বগুড়ার করোনেশন ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে আবদুর রাজ্জাক ভর্তি হন বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজে। স্বপ্ন ছিল, পড়াশোনা শেষে ব্যবসা করবেন। সেই স্বপ্নপূরণে ১৯৫৬ সালে নিউমার্কেটে ব্যবসা শুরু করেন। তবে শুরুতে তাতে সায় ছিল না বাবার। পরে অবশ্য বেলাল উদ্দিন ছেলের হাতে ব্যবসার জন্য ৫ হাজার টাকা হাতে তুলে দেন। তার মধ্যে ২ হাজার ৭৫০ টাকা দিয়ে একটা কাঠের দোকান ভাড়া নেন। বাকি ২ হাজার ২৫০ টাকা নিয়ে ছোটেন পুরান ঢাকার ইসলামপুরে। এভাবেই মাত্র ২ হাজার ২৫০ টাকা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন আবদুর রাজ্জাক। ব্যবসার টাকায় সংসার চালানোর পাশাপাশি বোনদের বিয়ে দেন। ছোট ভাইদের পড়াশোনা করান। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ব্যবসার পুঁজি। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধে সব স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যায় আবদুর রাজ্জাকের।
ছেলের হাতে নতুন যাত্রা
১৯৯৬ সালে মারা যান খোন্দকার আবদুর রাজ্জাক। তাঁর ছিল তিন মেয়ে ও দুই ছেলে। বড় ছেলে খোন্দকার মেজবাহুল হক। বাবার মৃত্যুর পর সংসার ও ব্যবসার হাল ধরেন তিনি। মেজবাহুল হকের মতে, বাবা মারা যাওয়ার পর ব্যবসায় নগদ পুঁজি বলতে তেমন কিছুই ছিল না। সম্বল ছিল শুধু নিউমার্কেটের কাপড়ের ব্যবসা ও বিসিকের শর্ষের তেলের কারখানা। তবে কোনো ব্যাংকঋণ ছিল না, এটাই ছিল বড় শক্তির দিক। সম্প্রতি বগুড়ার শহরের জলেশ্বরীতলায় রাজা গ্রুপের করপোরেট কার্যালয়ে কথা হয় গ্রুপটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মেজবাহুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর আমার অন্যতম লক্ষ্য ছিল ব্যবসা বড় করা। অল্প পুঁজি দিয়ে কীভাবে ব্যবসাটা বড় করা যায়, সেই চেষ্টা করতে থাকি। তবে সেটি করেছে সর্বোচ্চ সততা বজায় রেখে।’
মেজবাহুল হক বলেন, ‘শুরুতে কাপড়ের ব্যবসায় বেশি মনোযোগ দিই। চীন, ভারত, জাপান থেকে কাপড় এনে বিক্রি শুরু করলাম। অল্প সময়ের মধ্যে কাপড়ের ব্যবসায় বেশ ভালো করতে শুরু করলাম। ব্যবসার টাকায় ছোট ভাইকে বিদেশে পড়তে পাঠালাম। দুই বোনকে বিয়ে দিলাম। ২০০০ সালে কাপড়ের ব্যবসায় বেশ ভালো মুনাফা হলো। পাশাপাশি ঠিকাদারি ব্যবসা থেকেও হাতে কিছু টাকা জমল। সেই টাকায় ২০০৪ সালে শর্ষে তেলের কারখানাটি নতুন আঙ্গিকে চালু করলাম। ১২ ঘানি থেকে যুক্ত হলো ৭০ ঘানি। পরে যৌথ মালিকানায় বগুড়া শহরের কবি নজরুল ইসলাম সড়কে সেন্সবেরী নামে একটি সুপার শপ চালু করলাম। একসময় লক্ষ করলাম ব্যবসা বাড়লেও হাতে তেমন কোনো নগদ টাকা থাকত না। কারণ, লাভের সব টাকায় ছিল বাকিতে। বাকির টাকা তোলা ছিল বেশ কঠিন কাজ। তাই একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলাম বাকিতে আর ব্যবসা করব না। বন্ধ করে দিলাম বাকিতে লেনদেন। তাতে মাত্র দুই বছরে তার সুফল পেলাম। ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নগদ অর্থ জমা হলো। হাতে টাকা থাকায় ২০০৫ সালে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলায় গড়ে তুললাম কেবিএম ব্রিকস ফিল্ড নামের ইটভাটা। সেখানেও ছিল নগদে ব্যবসা। ২০০৭ সালে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের মাটিডালি এলাকায় ৩৪ শতক জায়গার ওপর চালু হয় “রাজা সিএনজি ফিলিংস্টেশন”। এরপর গড়ে তুলি কাগজের কারখানা।’
রাজা পেপার মিল চালুর বিষয়ে মেজবাহুল হক বলেন, ‘ইংল্যান্ডের একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে রাজা শর্ষের তেল রপ্তানি হতো। চীনেও ব্যবসার কাজে যেতাম আমি। সেই ব্যবসার সুবাদে পরিচয় হয় চীনের এক প্রকৌশলীর সঙ্গে। তিনি পেপার মিল কারখানার যন্ত্রপাতি বিক্রি করতেন। তিনিই মূলত বাংলাদেশে পেপার মিল চালুর পরামর্শ দেন। তাঁর পরামর্শেই ২০১৬ সালে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কামারদহে ২৪ বিঘা জায়গার ওপর রাজা পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস কারখানা চালু করা হয়। এ কারখানায় বর্তমানে নিউজপ্রিন্ট, হোয়াইট পেপার, হোয়াইট রাইটিং খাতা ৬০ জিএসএম এবং ফটোকপিয়ার ৫০-৫৫ জিএসএম—এই চার ধরনের পেপার তৈরি হয়। আমাদের উৎপাদিত কাগজের বাজার রাজধানীসহ দেশজুড়ে।
মেজবাহুল হক আরও বলেন, এ কারখানায় শিগগিরই আরও একটি নতুন ইউনিট চালু হবে। সেটি হবে দেশের প্রথম অত্যাধুনিক কাগজের কারখানা। যেখানে বিনিয়োগ হবে কয়েক শ কোটি টাকা।
বর্তমানে রাজা গ্রুপের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন মেজবাহুল হকের স্ত্রী আফরা আনিকা। সম্প্রতি আফরা আনিকা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পড়াশোনার পাশাপাশি স্বামীর ব্যবসা দেখভাল করছি। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন শিল্প ইউনিটে যাই। শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলি। উৎপাদনপ্রক্রিয়া পরিদর্শন করি। প্রতিটি কারখানায় শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ দেখে খুব ভালো লাগে। আমাদের সব কটি প্রতিষ্ঠানই এখন লাভজনক।’