আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন বেড়েছে
>• অবৈধ লেনদেন তদারক
• সন্দেহজনক লেনদেনের ৫ শতাংশ আমলে নেওয়া হয়
• সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ অর্থায়নের কারণে ২০টি ব্যাংক হিসাব জব্দ
আর্থিক খাতে সন্দেহজনক বা অস্বাভাবিক লেনদেন বেড়েছে। কয়েক বছর ধরেই বলা হচ্ছে, দেশে ঘুষ-দুর্নীতি, অর্থ পাচার, অনিয়ম, ঋণে জালিয়াতি ও কেলেঙ্কারি বাড়ছে। এখন বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যেও এর প্রমাণ মিলছে।
ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শুধু ২০১৬-১৭ অর্থবছরেই ২ হাজার ৩৫৭টি সন্দেহজনক বা অস্বাভাবিক লেনদেনের তথ্য দিয়েছে বিএফআইইউকে। আগের অর্থবছরে ১ হাজার ৬৮৭টি সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট জমা হয়। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিএফআইইউ মাত্র ১২১টি অস্বাভাবিক লেনদেনের বিষয়ে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোতে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছে, যা অস্বাভাবিক লেনদেনের মাত্র ৫ শতাংশ। এত কমসংখ্যক লেনদেনের তদন্ত হওয়ায় বেশির ভাগ বড় অপরাধ আড়ালেই থেকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক লেনদেন বাড়ছে, অনিয়মও বাড়ছে। এ কারণে আগের চেয়ে বেশি অভিযোগ হচ্ছে। তবে এসটিআরের মাত্র ৫ শতাংশ তদন্ত হলে তা খুবই নগণ্য। এর মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র আসবে না। সংস্থাটি নতুন করে কাজ শুরু করেছে, তাই জনবল ও প্রশিক্ষণের অভাব আছে। আন্তর্জাতিক রীতি মেনে যেহেতু পৃথক সংস্থা করা হয়েছে, তাই প্রশিক্ষণ ও জনবল দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে। ইব্রাহিম খালেদ আরও বলেন, সরকার যেভাবে ব্যাংকমালিকদের প্রশ্রয় দিচ্ছে, এ কারণেও সংস্থাটির কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
ঘুষ-দুর্নীতি, জঙ্গি বা সন্ত্রাসে অর্থায়ন, মানব পাচার, চোরাচালান, মুদ্রা জাল করা থেকে যেকোনো অপরাধের মাধ্যমে অর্থ আয়, অর্থ পাচার ও বেআইনি কোনো লেনদেনকে সাধারণভাবে মানি লন্ডারিংয়ের আওতায় আনা হয়। এসব ক্ষেত্রে কোনো সন্দেহজনক লেনদেন হলে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বিমা কোম্পানি, শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিএফআইইউতে রিপোর্ট করে। যাকে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন (এসটিআর) বলা হয়। এসব প্রতিবেদন ধরে তদন্ত করে বিএফআইইউ। এরপর ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন সংস্থায় প্রেরণ করে।
যোগাযোগ করা হলে বিএফআইইউর প্রধান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব সন্দেহজনক প্রতিবেদন আসে, তার সবই বিবেচনায় নেওয়া হয়। এর মধ্যে সন্ত্রাসে অর্থায়ন-সম্পর্কিত ঘটনা তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হয়। আমরা ৫ শতাংশ প্রতিবেদন তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সংস্থায় পাঠিয়েছি। অন্য অভিযোগগুলো জমা আছে, যেকোনো প্রয়োজনে তা ব্যবহার করা যাবে।’ রাজী হাসান বলেন, ‘অন্য দেশগুলো ২-৩ শতাংশ অভিযোগ তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট সংস্থায় প্রেরণ করে। আমরা তাদের থেকে বেশি অভিযোগ তদন্ত করেছি।’
বিএফআইইউর বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিএফআইইউ দুর্নীতি দমন কমিশনে ৭৩টি, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) ৩৮টি, ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটে ৯টি ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ১টি প্রতিবেদন পাঠায়। এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দুর্নীতি নিয়ে ৬৯টি, প্রতারণার ৪৭টি, জালিয়াতির ১১টি ও সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদে অর্থায়ন নিয়ে ১১টি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে সংস্থাটি। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে অর্থায়নের কারণে ২০টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করে সংস্থাটি।
এ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি সন্দেহজনক লেনদেন হয়। এ সময় প্রায় ২৫০ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন বেশি জমা হয়। ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় পরিবর্তন এবং নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান ব্যাংকটির শেয়ার কিনেছিল এ সময়টাতেই।
সন্দেহজনক এসব লেনদেনের মধ্যে ১ হাজার ৬৬৩টি অভিযোগ এসেছে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। আর মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশ থেকে অবৈধ উপায়ে আনা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স বিতরণের ক্ষেত্রে সন্দেহজনক লেনদেনের রিপোর্ট জমা হয়েছে ৬৪৪টি। ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৪২টি অভিযোগ। আর শেয়ারবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে এসেছে ৮টি।
সন্দেহজনক লেনদেন বৃদ্ধির সঙ্গে অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগের সংখ্যাও বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০১টি অভিযোগ এসেছে। আগের অর্থবছরে এসেছিল মাত্র ২০৯টি অভিযোগ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের অভিযোগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছে বাংলাদেশ পুলিশ থেকে, ১০৯টি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭১টি অভিযোগ এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে ১৪টি অভিযোগ আমলে নিয়েছে বিএফআইইউ। আর ব্যক্তি পর্যায়ে অভিযোগ এসেছে ১১টি। অন্যান্য মাধ্যমে এসেছে ৯৬টি অভিযোগ।
প্রসঙ্গত, ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) হিসাবে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে ২০১৪ সালে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি। আর ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা।