আরিফের দুই ডিমের গল্প
তাঁর বয়স তখন বছর আটেক হবে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়েন। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে মায়ের সঙ্গে নানিবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় নানির হাঁসের দুটি ডিম প্যান্টের পকেটে করে নিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকে শুরু। ওই দুই ডিম দিয়ে বাল্যকাল থেকে উপার্জন শুরু করেন। ডিম থেকে হাঁস, দুই হাঁস থেকে আরও হাঁস, হাঁস বিক্রি করে ছাগল, এক ছাগল থেকে পাঁচ ছাগল, ছাগল বিক্রি করে গাভি, গাভি-বাছুর বিক্রি করে মাছের ঘের, কৃষিকাজ... এমনভাবে উপার্জনের উৎসে ঘুরে ফিরেছেন এই তরুণ। চালিয়ে গেছেন পড়াশোনাও।
অনেকের কাছে এই তরুণের আয় খুব মামুলি মনে হবে। কিন্তু তিনি নিজে খুব সন্তুষ্ট। আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় হওয়া এই তরুণের কাছে এই উপার্জিত অর্থের মূল্য অনেক বেশি। যখন চাকরির জন্য গ্রাম থেকে শহরের দিকে ছোটার ঝোঁক তরুণদের, তখন তাঁর ভাবনা আলাদা। তাঁর ভাষায়, চাকরির পেছনে তিনি ছুটবেন না। গ্রামেই থাকবেন।
বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা ইউনিয়নের বেতাগা গ্রামের তরুণ আরিফ বিল্লাহর (২৪) লড়াইয়ের গল্প গ্রামের অন্য তরুণদের জন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরিফ এখন খুলনার হাজী আবদুল মালেক ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে মার্কেটিংয়ে সম্মান শেষ বর্ষের ছাত্র। আনিসুর রহমান আর জেসমিন নাহার দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে আরিফ ছোট। বড় ভাইয়ের নাম হোসাইন শেখ (৩১)। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপচারিতায় আরিফ বিল্লাহ জানালেন তাঁর সেই দুই ডিমের গল্প।
আরিফ জানান, ২০০৩ সালে খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার বাইনতলা গ্রামে নানির বাড়ি বেড়াতে গিয়ে ডিম দুটি নিয়ে ফেরেন। ওই সময় তিনি কালীবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ি এসে মায়ের মুরগির নিচে তা দিতে ডিম দুটি রাখেন। ২০ দিন পর সেই ডিম থেকে হাঁসের ছানা ফোটে। বাচ্চা দুটি বড় হলো। ডিম দেওয়া শুরু করল। বালক আরিফ ডিম বিক্রি করা শুরু করলেন। সেই টাকা দিয়ে দুটো কবুতর কিনলেন। তবে কবুতর দুটো রাখতে পারেনি। উড়ে যায়। পরে আরও দুটো কবুতর কেনেন।
আরিফ বলেন, ‘হাঁসের ডিম আর কবুতরের বাচ্চা বিক্রি করে টাকা ছোট চাচির (জাকিয়া বেগম) কাছে জমাতে শুরু করলাম। ১০/১২ টাকা করে করে জমাতে জমাতে এক বছরের কম সময়ের মধ্যে ৯৫০ টাকা জমা হয়। একদিন বাড়ির রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম, এক লোককে দেখলাম ছাগল নিয়ে যাচ্ছেন। ওই লোক হাটে ছাগল বিক্রি করতে নিয়ে গিয়েছিলেন। দাম চেয়েছিলেন এক হাজার টাকা। ওই দামে বিক্রি করতে না পেরে ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। আমি ওই লোকের সঙ্গে কথা বলে দৌড়ে বাড়ি গিয়ে সাড়ে ৯০০ টাকা নিয়ে এসে ছাগলটি কিনলাম।’
এরপর আরিফ ছাগলটি একজনের কাছে পালতে দেন। কথা হয়, ছাগলের বাচ্চার ভাগ হবে অর্ধেক অর্ধেক। সেই ছাগলের দুটি বাচ্চা হয়। এর মধ্যে একটি বাচ্চাকে শিয়াল কামড় দেয়। সেই বাচ্চাটি ছিল আরিফের ভাগের। চিকিৎসা করে বাচ্চাটিকে সুস্থ করে তোলেন। ২০০৬ সালে তাঁর ছাগলের সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচে। ওই বছর তিনটি ছাগল বিক্রি করে পান ৯-১০ হাজার টাকা। পরের বছর ২০০৭ সালে আরও দুটো বিক্রি করে মোট ১৪ হাজার টাকা জমিয়ে প্রতিবেশীর কাছ থেকে একটি গাভি কেনেন। তবে ওই বছরে আরিফের পরিবারে নেমে আসে দুর্যোগ। রোগভোগের পর বাবা মারা যান। আরিফ পড়াশোনা করতে চলে যান নানিবাড়ি।
২০১৩ সালে বটিয়াঘাটার খারাবাদ বাইনতলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন আরিফ। ওই কয় বছরে গাভির দুধ বিক্রির টাকা থেকে তাঁদের সংসার চলে। সেই টাকা থেকে তিনি দেড় শ কোয়েল পাখি কেনেন।
আরিফ বলেন, ‘৩৫ টাকা করে একেকটি কোয়েল কিনি। কোয়েলের পাশাপাশি ওই সময় আমার ছিল প্রায় এক ডজন কবুতর, পাঁচটি মুরগি, ছয়টি হাঁস। ডিম বিক্রি করতে থাকি। ফকিরহাট উপজেলায় সাকিনা আজহার টেকনিক্যাল কলেজে ভর্তি হই। বাসা থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে ছিল কলেজ। আব্বার সাইকেলে করে যাতায়াত করতাম। দুই বছরে ডিম, বাচ্চা আর বাছুর বিক্রি করে ৬৫ হাজার টাকা জমাই। ওই টাকা দিয়ে ২০১৫ সালে বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে শুভদিয়া গ্রামে সাত বিঘা জমি লিজ নিয়ে মাছের ঘের করি। বাড়ির কাছে বাবার ৬০ শতাংশ জমিতে কৃষিকাজ করতাম তারও আগে। ২০১৮ সালে বাড়ির ভেতর নতুন করে এক হাজার মুরগির খামার করি।’
এসব কাজের জন্য কোনো কর্মী নেই আরিফের। মাছ ধরার ও ধান কাটার সময় জেলে ও কৃষিশ্রমিক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভাড়া করেন।
আরিফের ভাষ্য, দিন পনেরো আগে ১ হাজার মুরগি ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। তীব্র শীত হওয়ায় সামান্য লাভে মুরগি বিক্রি করেছেন। এবার ধান বিক্রি করেও খুব একটা লাভ করতে পারেননি। ১৮০ মণ ধান উৎপাদন করেছিলেন। এর মধ্যে ১৩০ মণ বিক্রি করেন। কয়েক মাস আগে দুটি পুকুরের মাছ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। সব মিলিয়ে এ বছর সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় করেছেন।
বেশির ভাগ তরুণের মতো শহরে চাকরির স্বপ্ন বাদ দিয়ে কেন কৃষিতে যুক্ত হয়েছেন? জানতে চাইল আরিফ বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার আগ্রহের জায়গা ছিল কৃষি। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হব না, সেই চিন্তাভাবনা থেকে ছোটবেলা থেকে কাজে যুক্ত হয়েছি। পড়াশোনার খরচ নিজে চালাই। সব সময় ভেবেছি, আমাদের মতো নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য চাকরি পাওয়া সহজ নয়, তাই চাকরির পেছনে ছুটোছুটি করব না। শিক্ষা শুধু চাকরির জন্য নয়। আমার শিক্ষা আমি কৃষিতে লাগিয়েছি। চাষাবাদের জন্য কোনটা ভালো, তা নিয়ে নিজেই পড়াশোনা করি। ইন্টারনেটে মাছ চাষ, কৃষিতে সম্পৃক্ত মানুষের গ্রুপে নিয়মিত যোগাযোগ রাখি। তাঁদের কাছ থেকে পরামর্শ পাই।’
আরিফের পরিবারের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেতাগা ইউনাইটেড মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রদ্যুৎ কুমার দাশ বলেন, ‘আরিফের বাবা আমার সহপাঠী ছিলেন। আরিফের পরিবারের লোকজন অনেক ভালো, ভদ্র। বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারটি আর্থিক কষ্টে পড়ে। আরিফ কৃষিকাজ, মাছ চাষ করে উপার্জন করছে। পাশাপাশি পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। খেলাধুলাও করছে।’
আরিফের মতো অন্য শিক্ষিত তরুণদেরও এভাবে আত্মকর্মস্থানের ব্যবস্থা করা উচিত বলে মনে করেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘দেশে বেকারের সংখ্যা অনেক। সবাই তো চাকরি পাবে না। তাই চাকরির পেছনে ছোটাছুটি না করে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা উচিত। এতে পরিবারের মঙ্গল, দেশেরও মঙ্গল। শিক্ষিত তরুণেরা যদি এ ধরনের কর্মসংস্থানে যুক্ত না হয়, তাহলে দেশের উন্নয়নের যে স্বপ্ন আমরা দেখি, তা পূরণ হবে না।’
বেতাগা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য নির্মলেন্দু দেবনাথ বলেন, আরিফকে ব্যক্তিগতভাবে তিনি চেনেন। আরিফের উদ্যোগ এই গ্রামের তরুণদের জন্য অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক। শিক্ষিত তরুণদের আরও বেশি করে কৃষিকাজ, মাছ চাষ, খামারের মতো আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে যুক্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
আরিফের আরেকটি গুণ হচ্ছে, তিনি ভালো খেলোয়াড়। স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্স বাংলাদেশ (শি) নামের একটি সংগঠনের তত্ত্বাবধানে বাগেরহাট জেলার হয়ে রাগবি দলে খেলছেন। গত বছর ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত রাগবি টুর্নামেন্টে তাঁর অধিনায়কত্বে দলটি দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়। তিনি হন সেরা খেলোয়াড়।