আধা সরকারি কোম্পানির ৬০ কোটির বেশি টাকা নয়ছয়
>
- তেল কোম্পানিতে লুটপাট
- মহাব্যবস্থাপক আর বেসরকারি মালিকদের এক ভাই মিলে অন্তত ৬১ কোটি টাকা তুলেছেন
- কোম্পানির নানা স্তরের অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তার অভিযোগ
কোম্পানিটি যন্ত্রপাতি-ইঞ্জিনে ব্যবহারের জন্য তেল আমদানি, প্রক্রিয়াজাত ও বিক্রি করে। এর আধা মালিক সরকার। মহাব্যবস্থাপক সেখানে সরকারের প্রতিনিধি কর্মকর্তা। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানিটির বাকি অর্ধেকের মালিক দুই ভাই।
মহাব্যবস্থাপক আর বেসরকারি মালিকদের এক ভাই মিলে প্রায় আট বছর ধরে নিজেদের সইয়ে চেকের মাধ্যমে কোম্পানিটির অন্তত ৬১ কোটি তুলেছেন। তাঁরা নিজেদের মালিকানায় একই ধরনের কোম্পানি গড়ে সেগুলোর ব্যাংক হিসাবে এই টাকার বড় অংশ জমা দিয়েছেন। এই অভিযোগ করছেন কোম্পানির নানা স্তরের অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা। তাঁদের অভিযোগ, স্থায়ী আমানতের নামেও বড় অঙ্কের টাকা সরানো হয়েছে।
এই কোম্পানির নাম স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল), সাবেক ‘এসো’। নানা ধরনের লুব্রিকেন্ট তেল এদের পণ্য। এ ছাড়া তারা রাষ্ট্রায়ত্ত তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিপিসির কাছ থেকে বিভিন্ন জ্বালানি তেল ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) কিনে বিপণন করছে। বিপিসির কাছে কোম্পানিটি দেনাদার।
এসএওসিএলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ। আর বেসরকারি মালিক হলেন মঈন উদ্দিন আহমেদ। ২০১৪ সালের আগস্টে মঈন পিরামিড এক্সিম লিমিটেড নামে প্রাইভেট লিমিডেট কোম্পানি খুলেছেন। আর ২০১৫ সালে খোলা গুডউইন পাওয়ার লিমিটেড কোম্পানির একজন পরিচালক হলেন শাহেদ।
যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজেসকো) সূত্রে জানা গেছে, গুডউইন পাওয়ারের আরও অন্তত ছয়টি কোম্পানি রয়েছে, যেখানে শাহেদের সংশ্লেষ থাকতে পারে। চাকরির বিধিমালা অনুযায়ী এসএওসিএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এমন কোম্পানি খুলতে পারেন না।
সরকারের পক্ষে এসএওসিএলের তত্ত্বাবধায়ক প্রতিষ্ঠান বিপিসি। এর চেয়ারম্যান মো. সামছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানির ব্যাংক হিসাব থেকে বিপুল অঙ্কের নগদ টাকা তোলার বিধান নেই। আয়–ব্যয়ের হিসাব খতিয়ে দেখতে বিপিসি একটি কমিটি করেছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিপিসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার জানামতে ২০১৩ সাল থেকে বার্ষিক হিসাব নিরীক্ষা তারা বন্ধ রেখেছে। এজিএম (বার্ষিক সাধারণ সভা) বন্ধ রয়েছে ২০১৭ থেকে।’ অভিযোগের বিষয়ে তাঁর জানা নেই। তা ছাড়া এতে সরকারি ও বেসরকারি মালিকানা সমান। বিপিসিকে সব তথ্য দেওয়ার কথা, কিন্তু কোম্পানিটি দেয় না।
গত বছরের ১৬ অক্টোবর মোহাম্মদ শাহেদ মুঠোফোনে সব অভিযোগকে ‘মিথ্যা কথা’ বলেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুললে তিনি মুঠোফোন কেটে দেন। এর আগে মঈন উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সাংবাদিক পরিচয় জানার মুঠোফোনের কল কেটে দেন। এঁদের সঙ্গে আবারও যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।
টাকা নয়ছয়ের পন্থা
এসএওসিএল সূত্রে জানা যায়, মঈন উদ্দিন আহমেদ ২০১১-এর জুলাই থেকে ২০১২-এর জুন পর্যন্ত ১৩৮টি চেকের মাধ্যমে ১৪ কোটি ৭৯ লাখ ৯৫ হাজার ১৯১ টাকা নিয়েছেন। কর্মকর্তারা বলছেন, এ টাকা তাঁর ফেরত দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি তা দেননি।
কোম্পানির প্রশাসন ও হিসাব বিভাগের সূত্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত আগ্রাবাদে চারটি ব্যাংকে কোম্পানির ব্যাংক হিসাব থেকে ১২১টি চেকের মাধ্যমে মোট ৪৬ কোটি ৪৫ লাখ ৬ হাজার টাকা নগদ তোলা হয়েছে। ব্যাংকগুলো হচ্ছে মেঘনা ব্যাংক, আইএফআইসি, মিডল্যান্ড ও এনসিসি ব্যাংক।
সূত্রগুলো বলছে, টাকা তোলার প্রতি তারিখে একই অঙ্কের টাকা পিরামিড এক্সিম এবং গুডউইনের ব্যাংক হিসাবে জমা পড়েছে। এই দুভাবে মোট অন্তত ৬১ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে।
মঈন উদ্দিন আহমদের নিজস্ব কোম্পানি পিরামিড এক্সিম এবং মোহাম্মদ শাহেদের কোম্পানি গুডউইন পাওয়ার দুটোই লুব তেল আমদানি ও বিপণন করে। এই দুই কোম্পানির নামে চট্টগ্রামে সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেড ও প্রিমিয়ার ব্যাংক লিমিটেডের আগ্রাবাদ শাখায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বড় বড় অঙ্কের নগদ টাকা জমা পড়েছে বলে ওই সূত্রে জানা গেছে। জমা পড়া টাকার বেশির ভাগই পিরামিডের নামে।
এসএওসিএলের হিসাব ও প্রশাসনিক বিভাগের কয়েকটি সূত্র অনুযায়ী, এ টাকাগুলো ভুয়া ভাউচারের নামে ওই কোম্পানি থেকে তুলে নেওয়া। যা ওই পিরামিড এক্সিম ও গুডউইনের ব্যাংক হিসাবে জমা পড়েছে। একই তারিখে টাকা জমা পড়ে আগ্রাবাদে মোহাম্মদ শাহেদের কোম্পানি গুডউইন পাওয়ার লিমিটেডের প্রিমিয়ার ব্যাংকের হিসাবে।
সূত্র জানায়, ওই টাকা ব্যাংকে জমা দিয়েছিলেন এসএওসিএলের হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা আতিকুর রহমান। জানতে চাইলে ১ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শাহেদ স্যার আমাকে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে বলেছেন সেখানে টাকা জমা দিতে। আমি তাঁর নির্দেশ পালন করেছি। আমি তো এ রকম অনেক টাকা স্যারের হয়ে জমা দিয়েছি। আমি তো জানি না এটা কার টাকা, কেন দিচ্ছে।’
হিসাব বিভাগের সাবেক প্রধান বেলায়েত হোসেন মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি তো কোম্পানির চেকের স্বাক্ষর করার ক্ষমতা রাখি না, সেটি রাখেন শাহেদ স্যার ও মঈন উদ্দিন স্যার। কোম্পানির সর্বোচ্চ ব্যক্তিরা যদি আমাকে চেক দিয়ে টাকা আনতে বলেন, সেখানে আমার কী করার আছে। তাঁরা নির্দেশ দিয়েছেন, স্বাক্ষর দিয়েছেন; আমি টাকা এনে দিয়েছি।’
পুরো ঘটনাটি সম্পর্কে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি অবিশ্বাস্য। কল্পনাও করা যায় না। এভাবে নগদ অর্থ তুলে নেওয়া নজিরবিহীন।’ তিনি বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে জড়িত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।
বিপিসির সঙ্গে সম্পর্ক
এসএওসিএল বিপিসির কাছ থেকে ফার্নেস তেল ও ডিজেল কিনে ডিলারদের মাধ্যমে বিক্রি করে থাকে। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, বিপিসি কোম্পানিটির কাছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পায়। এরপর আর কোনো এজিএম না হওয়ায় হালনাগাদ বকেয়ার হিসাব খোদ বিপিসিও জানে না।
সাবেক একজন জ্বালানিসচিব এসএওসিএলের বোর্ড চেয়ারম্যান ছিলেন। কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, ওই সচিবের খামারের নির্মাণসামগ্রী এসএওসিএলের তহবিল থেকে দেওয়া হয়েছে।
২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ওই সচিবের নামে বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন ‘অমসৃণ চিরাই কাঠ’ সরবরাহের অনুমোদন বরাদ্দ করে। এর দাম ছিল প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা।
এর তিন দিন পর চট্টগ্রাম ইপিজেডের ব্যাংক এশিয়ায় এসএওসিএলের হিসাব থেকে একই অঙ্কের একটি নগদ চেক ছাড় হয় বলে এসএওসিএল সূত্রে জানা গেছে। চেকটি ছিল কোম্পানির হিসাব বিভাগের প্রধান বেলায়েত হোসেনের নামে।
বেলায়েত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ কোম্পানির হিসাব থেকে একটি চেক দিয়েছিলেন আমাকে। সেই অর্থ তুলে জমা দিয়েছি।’
বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব নূরুল আমিন ২০১৫ সালে বিপিসির সচিব ছিলেন। সূত্র জানায়, সে বছরের ২৫ এপ্রিল কোম্পানির আগ্রাবাদের আইএফআইসি ব্যাংক হিসাব থেকে ২০ লাখ টাকা নগদ তোলা হয়। এ টাকা দেওয়া হয় মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নওগাঁ জেলা শাখায় মেসার্স স্টোন রাইস মিলসের ব্যাংক হিসাবে। ডিসেম্বরে দেওয়া হয় আরও ১০ লাখ টাকা।
কোম্পানির পক্ষ থেকে টাকা জমাদানকারীরা বলছেন, এটি বেনামে নূরুল আমিনের প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত বছরের ১৬ অক্টোবর মুঠোফোনে নূরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি টাকাটা এসএওসিএলের তহবিল থেকে ধার নিয়েছিলেন।
বিপিসির কর্মকর্তা হয়ে এটা তিনি করতে পারেন কি না, জানতে চাইলে নূরুল আমিন বলেন, ‘আমি তো জানি, টাকাটা এসএওসিএলের জিএম শাহেদ সাহেব তাঁর ব্যক্তিগত হিসাব থেকে দিয়েছেন।’
হিসাব জানতে চেয়ে বিপিসির কমিটি গঠন
এসএওসিএলের ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়-ব্যয়, অডিট, বিনিয়োগ ইত্যাদিসহ সার্বিক আর্থিক কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার জন্য বিপিসি ১১ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ মেহদী হাসানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটিকে আগামী ১০ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটি সরেজমিন এসএওসিএলের চট্টগ্রাম কার্যালয়ে যাবে আজ।
এদিকে কমিটি এসএওসিএলের আয়-ব্যয়ের হিসাব যাতে না করতে পারে, সে জন্য এসএওসিএলের বেসরকারি অংশীদার মঈন উদ্দিন আহমেদ ৩৬ ঘণ্টার সময়সীমা বেঁধে একটি লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছে বিপিসিকে। গত বৃহস্পতিবার লিগ্যাল নোটিশের সময়সীমা শেষ হয়েছে। আর ওই দিনই লিগ্যাল নোটিশটি বিপিসিতে এসে পৌঁছায়। আজ তদন্ত কমিটি ঠেকাতে মঈন উদ্দিন আহমেদের আদালতে যাওয়ার কথা রয়েছে।