আগামী ৩০ নভেম্বর ২০২০ ব্যক্তি করদাতাদের আয়কর রিটার্ন ২০২০-২১ করবর্ষ ও ২০১৯-২০ আয় বর্ষের জমা দেওয়ার শেষ তারিখ (অর্থাৎ ১ জুলাই ২০১৯-থেকে ৩০ জুন ২০২০ পর্যন্ত সময়ের আয়ের জন্য)।
এ বছর মেলাবিহীন এবং করনাকালে আয়কর জমা দিতে হবে। অনেকের আয়ও হয়তো কমে গেছে। আয়কর আইন সংশোধন করার পরিপ্রেক্ষিতে যাঁদের টিআইএন আছে (যাঁরা ৩০ জুন ২০২০-এর আগে টিআইএন গ্রহণ করেছেন), তাঁদের আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। গত বছর ৪০ লাখের বেশি টিআইএনধারী করদাতার মধ্যে ১৭ থেকে ১৮ লাখ আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছিলেন। আয়কর ফাইল একজন করদাতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আয়কর ফাইল ত্রুটিপূর্ণ হলে তাঁর সার্বিক ক্ষেত্রেই অসুবিধায় পড়তে হতে পারে।
আমরা জমি, ফ্ল্যাট, স্থায়ী আমানত বা এফডিআর, সঞ্চয়পত্র, ইত্যাদির দলিল বা নথি যেভাবে সংরক্ষণ করি, প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায় আয়করের ফাইল সেভাবে অনেকেই সংরক্ষণ করেন না। আয়কর ফাইল সঠিকভাবে রাখা কর ব্যবস্থাপনার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আবার অনেকের পক্ষেই কিন্তু আয়কর অধ্যাদেশ, প্রজ্ঞাপন, অর্থ আইন, আয়কর পরিপত্র বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা খুবই কঠিন। আয়কর আইন প্রতিবছর সংশোধন ও পরিমার্জন হয়। তবে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতা, যাঁরা চাকরিজীবী বা ছোটখাটো ব্যবসা করেন, তাঁদের জন্য খুব একটা অসুবিধা হয় না। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই একটু সচেতন হতে হবে।
এ বছর যেহেতু ৩০ জুন ২০২০-এর আগে যাঁরা টিআইএন গ্রহণ করেছেন, তাঁদের আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। আবার এ বছর অনলাইনে আয়কর জমা দেওয়ার ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। তবে এ বছর আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে, যা অল্প সময়ে মধ্যে সবার রিটার্ন জমা দেওয়া সম্ভব। যাঁদের মোট পরিসম্পদ ৪০ লাখ টাকার নিচে, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁরা শুধু এক পাতার ফরম পূরণ করে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে পারবেন।
বর্তমান সময়ে যাঁদের পক্ষে স্বল্পতম সময়ে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া খুবই কষ্টকর, তাঁরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত ফরমে সময় বাড়ানোর আবেদন করতে পারবেন। তবে ২ শতাংশ হারে বিলম্ব সুদ আরোপযোগ্য হবে। এ ক্ষেত্রে উপকর কমিশনার দুই মাস এবং পরবর্তী সময়ে যুগ্ম বা অতিরিক্ত কর কমিশনার আরও দুই মাস সময় মঞ্জুর করতে পারবেন। তবে অবশ্যই করদাতাকে তার যুক্তি সংগত কারণ দেখাতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থ হলে আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী জরিমানা আরোপ হবে।
ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার ক্ষেত্রে পুরুষ করদাতার ক্ষেত্রে ৩ লাখ টাকা, মহিলা অথবা ৬৫ বছরের অধিক পুরুষ করদাতার ক্ষেত্রে সাড়ে ৩ লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী করদাতার ক্ষেত্রে সাড়ে ৪ লাখ টাকা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। আবার কোনো প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পিতামাতা বা আইনানুগ অভিভাবকের জন্য করমুক্ত সীমা ৫০ হাজার টাকা বেশি হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পিতা ও মাতা উভয়েই করদাতা হলে যেকোনো একজন এই সুবিধা ভোগ করবেন।
আয় নির্ধারিত সীমার নিচে হলে করদাতাকে আয়কর রিটার্ন দিতে হবে কিন্তু আয়কর দিতে হবে না। শুধু করসীমা অতিক্রম করলেই আয়কর দিতে হবে। অর্থাৎ করসীমার ওপর ১ টাকার বেশি হলেও তাঁকে ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম করের হার ৫ হাজার টাকা, অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম করের হার ৪ হাজার টাকা, সিটি করপোরেশন ব্যতীত অন্যান্য এলাকায় অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম করের হার ৩ হাজার টাকা প্রদান করতে হবে।
আয় নির্ধারিত সীমার নিচে হলে করদাতাকে আয়কর রিটার্ন দিতে হবে কিন্তু আয়কর দিতে হবে না। শুধু করসীমা অতিক্রম করলেই আয়কর দিতে হবে। অর্থাৎ করসীমার ওপর ১ টাকার বেশি হলেও তাঁকে ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে।
বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা হবে করযোগ্য মোট আয়ের (কর অব্যাহতি প্রাপ্ত বা হ্রাসকৃত করহারের আয় ব্যতীত) ২৫%; বা প্রকৃত বিনিয়োগ; অথবা ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা; এই তিনটির মধ্যে যেটি কম। রেয়াতের পরিমাণ নির্ধারিত হবে মোট আয় ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫% হারে এবং ১৫ লাখ বেশি হলে ১০% হারে।
করদাতার মোট পরিসম্পদ যদি তিন কোটির বেশি বা একের অধিক মোটরগাড়ি বা ৮ হাজার বর্গফুটের অধিক আয়তনের গৃহসম্পত্তি থাকে, তাঁকে ১০ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত সারচার্জ প্রদান করতে হবে।
এখন আয়করের হার হচ্ছে: প্রথম ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর শূন্য, পরবর্তী ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মোট আয়ের ওপর ২০ শতাংশ, অবশিষ্ট মোট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ।
যদি কোনো কারণে আপনার আয়কর ফাইলে পূর্বে নগদ অর্থ, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি দেখানো না থাকে, নির্দিষ্ট কর দিয়ে যেমন নগদ টাকার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং জমি, ফ্ল্যাট বা বিল্ডিং হলে পরিমাপের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট হারে ট্যাক্স দিলে আপনাকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।
আয়কর বিষয়ে কয়েকটি টিপস
১. গত বছরের রিটার্নের ফটোকপি সঙ্গে রাখুন।
২. প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের একটি তালিকা তৈরি করুন।
৩. কাগজগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা করুন নির্দিষ্ট সময়ের কি না। যেমন ২০২০-২১ কর বছরের জন্য জুলাই ২০১৯ থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে হতে হবে।
৪. রিটার্নের একটি ফটোকপি করুন এবং গত বছরের রিটার্ন দিয়ে খসড়া রিটার্ন তৈরি করুন।
৫. প্রতিটি কাগজের দুটি করে কপি করুন।
৬. স্বাক্ষর করার আগে কম পক্ষে দুবার চেক করুন।
৭. যাঁরা নিজে রিটার্ন পূরণ না করে অন্যদের ওপর নির্ভরশীল, তাঁরা সুপ্রশিক্ষিত এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি ছাড়া কোনোমতেই খালি বা সাদা রিটার্নে স্বাক্ষর করবেন না।
৮. স্বাক্ষর করার আগে গত বছরের সম্পদগুলো যথাযথ পরীক্ষা করুন এবং এই বছরের নতুন কোনো সম্পদ থাকলে তা ভালোভাবে পরীক্ষা করুন।
৯. মনে রাখবেন, আয়নার সামনে দাঁড়ালে আপনার চেহারা যেমন দেখা যাবে, রিটার্নে আপনার সম্পদের আয় এবং ব্যয়ের সম্পূর্ণ চিত্র ফুটে উঠবে।
১০. স্বাক্ষর করার পর একটি সেট আপনার ট্যাক্স ফাইলে সংরক্ষণ করুন।
১১. রিটার্ন জমা হওয়ার পর রিটার্ন জমা দেওয়ার স্লিপ সংগ্রহ করুন।
মো. জাহাঙ্গীর আলম: আয়কর আইনজীবী, নির্বাহী পরিচালক, গোল্ডেন বাংলাদেশ।