অলিম্পিক আয়োজনে লাভ না ক্ষতি!
যারা অলিম্পিকের স্বাগতিক দেশ হয়, তাদের বেশ বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। আশা করা হয় যে অলিম্পিক ঘিরে অর্থনীতিতে যে চাঙা ভাব আসে, তা থেকে টাকা উঠে আসবে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা হয় না, মাঝেমধ্যে অলিম্পিকের পর স্বাগতিক দেশগুলো ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
স্বাগতিক দেশের অলিম্পিকের খবর শুরু হয় স্বাগতিক হওয়ার চেষ্টা থেকেই। একটা দেশ অলিম্পিকের মতো বড় আসর আয়োজন করতে পারবে কি না, তা খতিয়ে দেখতে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি অনেক যাচাই-বাছাই করে। সে জন্য উপদেষ্টাদের সম্মানী, ভ্রমণ, আয়োজনের পূর্বপ্রস্তুতি ইত্যাদি বাবদ খরচ করতে হয় আয়োজকদের। এতে সাধারণত ৫ থেকে ১০ কোটি ডলার বের হয়ে যায়। এরপরও যে আয়োজক দেশ হওয়া যাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। ২০২০ অলিম্পিকের (এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে) স্বাগতিক দেশ জাপান ২০১৬ সালে অলিম্পিক আয়োজনের স্বাগতিক হতে ১৫ কোটি মার্কিন ডলার খরচ করেছিল। কিন্তু সে বছর তাদের খালি হাতেই ফিরতে হয়। পরে আরও সাড়ে সাত কোটি ডলার খরচ করার পর এ বছর তারা স্বাগতিক দেশ হতে পেরেছে।
স্বভাবতই স্বাগতিক হওয়া স্বাগতিক হওয়ার চেষ্টার চেয়েও বেশি খরুচে ব্যাপার। যেমন ২০১২ সালের অলিম্পিক ও প্যারা অলিম্পিক আয়োজন করতে যুক্তরাজ্যের খরচ হয়েছিল ১ হাজার ৪৫০ কোটি ডলার, যার ৪৪০ কোটি ডলার এসেছে দেশটি রাজস্ব আয় থেকে। ২০০৮ সালে বেইজিং ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলার খরচ করে অলিম্পিক আয়োজন করেছিল, আর ২০০৪ সালের এথেন্স অলিম্পিকের খরচ ছিল ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।
এই বিশাল অর্থ খরচ করতে স্বাগতিক দেশগুলোর সরকারদের ধারদেনা করতে হয়। জনগণের করের অর্থ থেকেই তা পরিশোধ করতে হয়। যেমন এথেন্সের করদাতাদের বছরপ্রতি ৫৬ হাজার মার্কিন ডলার সমমানের অর্থ পরিশোধ করতে হয়েছে, যত দিন দেনা পুরোপুরি শোধ হয়নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এত টাকা কোথায় যায়। প্রথমত, স্বাগতিক শহরের সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়। নতুন রাস্তাঘাট করতে হয়, বিমানবন্দরও অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য সাজাতে হয়। স্টেডিয়াম বানানো, অলিম্পিক দেখতে আসা দর্শকদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাওয়ার ব্যবস্থাপনা করা, ক্রীড়াবিদদের আবাসনের ব্যবস্থা করা—সব মিলিয়ে ৫০০ থেকে ৫ হাজার কোটি ডলার পর্যন্ত খরচ করতে হয়।
খরচের পুরোটাই জলে যায় তা অবশ্য নয়। আয়োজন বাবদ ব্যয়ের একটি অংশ টাকা দেশেই থেকে যায়। কিছু অস্থায়ী কাজের সুযোগ তৈরি হয়; আবার রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো পরবর্তীকালে দেশের মানুষের চলাচল ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে আসে। অলিম্পিক দেখতে আসা পর্যটকেরাও অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন।
বিনিয়োগ ধরে বিবেচনা করলে অবশ্য ইতিবাচকের চেয়ে নেতিবাচক দিকই বেশি চোখে পড়ে। যেমন ২০১২ সালের লন্ডনের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে আয় হয়েছিল ৫০ কোটি মার্কিন ডলার, অথচ খরচ ছিল ১ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। ২০১০ সালে ভ্যাঙ্কুভারও ৭৬০ কোটি ডলার খরচ করে তুলতে পেরেছিল ২৮০ কোটি ডলার। অলিম্পিক আয়োজনে একমাত্র লস অ্যাঞ্জলেসেরই ক্ষতি কম হয়েছিল, কারণ শহরটিতে কয়েকবার অলিম্পিক আয়োজন হওয়ায় তাদের অবকাঠামো তৈরিতে খরচ হয়েছিল কম।
অলিম্পিক আয়োজনের জন্য খরচ অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদি বাজে খরচের কারণও হয়। সিডনির কথাই ধরা যাক, অলিম্পিক আয়োজনের জন্য তারা যে স্টেডিয়াম তৈরি করেছিল, সেটার রক্ষণাবেক্ষণের বার্ষিক খরচ ৩ কোটি মার্কিন ডলার।
এবার কোভিড মহামারির কারণে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের আর্থিক ঝুঁকি আরও বেশি। এমনিতেও অলিম্পিক আয়োজন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। সেটা এক বছর পিছিয়ে এ বছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির কাছ থেকে অলিম্পিক আয়োজনের ছাড়পত্র পেতে জাপানকে দেখাতে হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার খরচের ক্ষমতা। যে কারণে ইতালিকে পেছনে ফেলে স্বাগতিক হওয়ার গৌরব অর্জন করে জাপান। কোভিডের জন্য এক বছর পিছিয়ে জাপানের ইতিমধ্যেই অতিরিক্ত ২৮ কোটি ডলার বেশি খরচ হচ্ছে। সব মিলিয়ে খরচ ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলার।
করোনার কারণে এ বছর অলিম্পিক থেকে পর্যটন বাবদ আয় আসছে না। বরং খেলোয়াড়দের করোনা পরীক্ষা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে আবার বিদেশ থেকে আসা অনেক ক্রীড়াবিদের করোনা শনাক্ত হয়েছে, তাঁদের দেখভালের খরচ তো আছেই। এ ছাড়া টোকিও শহরে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় জাপানের খরচ আরও বেড়ে গেছে।
সব মিলিয়ে নিন্দুকেরা যে বলে, অলিম্পিক আয়োজনে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, কথাটা ভুল নয়। প্রথমবার অলিম্পিক আয়োজন করে এখন আর কোনো দেশ লাভের মুখ দেখবে না। আবার বারবার স্বাগতিক হওয়াও খুব সহজ কথা নয়। সব মিলিয়ে অলিম্পিক আয়োজন না করাই হবে অর্থনৈতিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত।