সিপিডির সংলাপে অভিমত
অনুমানের ভিত্তিতে বাজেট হয়েছে
যথাযথ তথ্য-উপাত্ত নেই। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার তথ্যের সঙ্গে বাজেটের তথ্যের মিল কম।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্যের সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেটের কোনো সাযুজ্য নেই। কোভিড-১৯ মাথায় রেখে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা সংশোধন করার পরও সেটির সঙ্গে বাজেটের তথ্যের মিল কম। কারণ, বাজেটের অনেক কিছুই করা হয়েছে অনুমানের ভিত্তিতে।
গতকাল শনিবার বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত বাজেটবিষয়ক এক সংলাপে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান প্রধান অতিথি এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী সম্মানিত অতিথি ছিলেন।
সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান। সংস্থাটির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানের সঞ্চালনায় ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট ও অর্থনীতির ওপর সার্বিক পর্যালোচনা তুলে ধরেন এর নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
সিপিডি নিজস্ব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জিত হবে, সেই সম্পর্কে কোনো দিকনির্দেশনা নেই বাজেটে। আবার ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাবও এখনো পাওয়া যায়নি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়েনি এবং ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো প্রণোদনা ঋণ পায়নি।
সংস্থাটি জানায়, রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা রয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে যা অর্জিত হয়েছে, তা গতবারের তুলনায় একটু বেশি। তবে বাকি দুই মাসের লক্ষ্যমাত্রা অবিশ্বাস্য, ১২২ শতাংশ। সরকারি ব্যয়ও কম এবার। আর স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাস্তবায়ন ২৫ শতাংশ, যা একেবারেই আকাঙ্ক্ষিত নয়। যে বছরে ব্যয় বেশি হওয়া দরকার, সে বছরেই কিনা বাজেট সম্প্রসারণমূলক না হয়ে এর পরিবর্তে সংকোচনমূলক হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটকে বিরাট বলে মনে করে না সিপিডি। বলছে, জিডিপির আকার যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু ব্যয়ের পরিমাণও বাড়বে। আয় কোথা থেকে আসবে, সেই পথনকশা নেই। বৈদেশিক উৎস থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক আছে। আবার বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর যে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, তাতে উচ্চশিক্ষার ব্যয় বাড়বে। এ ছাড়া সংস্কার, প্রযুক্তির ব্যবহার ও দক্ষ মানবশক্তি না থাকলে সবকিছু কাগজে–কলমেই থেকে যাবে।
অর্থমন্ত্রী বেসরকারি সংস্থার দারিদ্র্যের হিসাব না মানতে পারেন। তবে তাঁর উচিত হবে, বিকল্প তথ্য-উপাত্ত তৈরি করে তা উপস্থাপন করা।রেহমান সোবহান, চেয়ারম্যান, সিপিডি
সিপিডির মতে, গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের বরাদ্দ বাজেটে কমেছে। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও (এডিপি) প্রকল্পের ভারে জর্জরিত। এ ছাড়া ক্ষুদ্রদের প্রণোদনা প্যাকেজ দিতে এনজিওগুলোকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, ব্যাংক খাতে বড় অঙ্কের তারল্য পড়ে থাকা এবং এর যথাযথ ব্যবহার না হওয়ায় প্রশ্ন তোলেন। তিনি আমদানি বিকল্প শিল্পায়ন ও রপ্তানি বহুমুখীনতার প্রতিও জোর দিতে বলেন।
রেহমান সোবহান বলেন, অর্থমন্ত্রী বেসরকারি সংস্থার দারিদ্র্যের হিসাব না মানতে পারেন। তবে তাঁর উচিত হবে, বিকল্প তথ্য-উপাত্ত তৈরি করে তা উপস্থাপন করা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বিবিএসকে আরও কার্যকর করা হবে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিনিয়ত শুনছি। কর্মকর্তাদের বলি, তাঁরা যেন আরও ভালো করেন। শুধু আদেশের অপেক্ষায় না থাকেন। নিজেরা যেন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজ করেন।’
ভ্যাট সংগ্রহে ব্যর্থ হওয়ার কথাও স্বীকার করেন পরিকল্পনামন্ত্রী। বলেন, ‘যদি ভ্যাটটা আমরা কাজে লাগাতে পারতাম! অদ্ভুত দেশ! একশ্রেণির ব্যবসায়ী বিরোধিতা করেন। অথচ ভ্যাট দেন ক্রেতারা।’
সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সংসদে আছি মানুষের চাহিদার কথা ব্যাখ্যা করা ও তুলে ধরার জন্য। কিন্তু আমরা যদি সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকি, তাহলে সেই বিষয়গুলো কেন আসবে? আমরা সংসদে আছি শুধু হ্যাঁ বা না বলার জন্য।’
নির্ধারিত আলোচনা
সংলাপে নির্ধারিত আলোচকদের মধ্যে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, বাজেটে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, এটা খুবই আশাব্যঞ্জক। আর এনবিআর থেকে নীতি ও বাস্তবায়ন আলাদা করতে ২০০৯-১০ অর্থবছরে জারি হওয়া প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়িত হয়নি বলে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কোনো অগ্রাধিকার খাত নেই। পিছিয়ে পড়া বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য যেমন কিছু নেই, তেমনি ব্যাংক খাত সংস্কারের জন্যও কিছু বলা নেই। এই ব্যাংক খাত দিয়ে এগোনো যাবে না।
মেট্রো চেম্বারের সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসায়ীদের খালি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা লুটেরা। কদিন ধরে লাগাতার এসব বলা হচ্ছে। কথাগুলো শুনতে আমি আগ্রহী নই। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অনেক কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। অথচ সরকার এক হাত দিয়ে ব্যবসায়ীদের দেয়, অন্য হাত দিয়ে তাদের থেকে নেয়।’
ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব স্মল অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অব বাংলাদেশের (নাসিব) সভাপতি মির্জা নুরুল গণি বলেন, বড়দের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ মুহূর্তেই বিতরণ হয়ে যায়, হয় না শুধু এসএমইর। এ ব্যাপারে সমীক্ষা হওয়া দরকার।
বিএনপির সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, বিশেষ অবস্থার বাজেটটি বিশেষ ধরনের হবে বলে আশা ছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, স্বাস্থ্য খাত সার্বিক অবহেলার শিকার। নতুন দরিদ্র নিয়ে বেসরকারি সংস্থার ফল অর্থমন্ত্রী না মানলে সরকারি সংস্থা গবেষণা করুক।
বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির বলেন, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। হার্ডওয়্যারের জন্য বড় বরাদ্দ থাকলেও সফটওয়্যারের জন্য থাকে না।