ডিমের বাজারে অভিযানে উল্টো ফল
ডিমের দাম কমাতে বাজারে অভিযানে নেমেছে সরকার। কিন্তু তাতে দাম তেমন একটা কমেনি। বরং কিছু কিছু পাইকারি বাজারে ডিম বিক্রি বন্ধ অথবা কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এতে বরং সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে।
ঢাকার বাজারে গতকাল সোমবার ব্রয়লার মুরগির বাদামি ডিম বিক্রি হয়েছে প্রতি ডজন (১২টি) ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা দরে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত ৮ আগস্ট ডিমের দাম ছিল ডজনপ্রতি ১৫০ থেকে ১৬২ টাকা।
স্বল্প আয়ের মানুষের প্রাণিজ আমিষের বড় উৎস ডিমের দাম বাড়ছিল ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে। ধাপে ধাপে বেড়ে তা ১৫০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। কখনো কখনো দাম ওঠে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। এর আগে বছরজুড়ে ডিম ডজনপ্রতি ৮০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করত।
ডিমের মূল্যবৃদ্ধির জন্য খামারিরা উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং সরবরাহ–সংকটকে দায়ী করছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই দুটি সমস্যা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার ৮ অক্টোবর সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ কমানোর দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দুটি কাজ করা জরুরি। প্রথমত, এখন স্বল্প মেয়াদে ঘাটতি মেটাতে ডিম আমদানি করতে হবে। আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুল্কছাড় দেওয়া হয়নি। সরকার শুল্কছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে আমদানিকারক পর্যায়ে খবর ছড়িয়েছে। কিন্তু প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশে খরচ এত বেশি কেন, সেটা পর্যালোচনা করে বাজারকৌশল নির্ধারণ করতে হবে। পোলট্রি খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণের বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করে দাম কমানো দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ডিমের বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা দরকার। সেটা করা যেতে পারে সরবরাহ বাড়িয়ে। সরবরাহ কম থাকলে বাজারে কারসাজি করার সুযোগ তৈরি হয়। তখন অভিযান চালিয়ে আসলে কোনো লাভ হয় না।
কিছু আড়তে ডিম বিক্রি বন্ধ
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর গত ১৬ সেপ্টেম্বর ব্রয়লার মুরগির ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয়। বেঁধে দেওয়া দাম অনুসারে, উৎপাদক পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের মূল্য ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা ১ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে তা ১১ টাকা ৮৭ পয়সা হওয়ার কথা। সে হিসাবে খুচরা পর্যায়ে এক ডজন ডিমের দাম হয় ১৪২ টাকা।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর জানিয়েছে, ডিম উৎপাদক ও পাইকারি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেই তারা ডিমের ‘যৌক্তিক দাম’ নির্ধারণ করেছিল। অবশ্য পোলট্রি খাতের অনেকে বলছেন, দাম নির্ধারণ করতে হলে উৎপাদন খরচ নিয়ে গবেষণা দরকার। কাজটি করতে পারে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
এদিকে নির্ধারিত দর বাস্তবায়ন করতে ডিমের বাজারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। যৌক্তিক মূল্যে ডিম বিক্রি না করলে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায়ীদের জরিমানাও করছে। মূলত অভিযানের ভয়েই ডিম বিক্রি বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন ঢাকার তেজগাঁওয়ে ডিমের পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা।
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ আমানত উল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত দামে কিনতে পারলে নির্ধারিত দরে বিক্রি করা যায়। বাড়তি দামে কেনাবেচার কারণে শুধু তাঁদের দায়ী করা হচ্ছে, অভিযান চালানো হচ্ছে। এ জন্য ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন তাঁরা।
সরকারি দরে ডিম কিনতে না পারার কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী বাজারেও পাঁচটি আড়তে ডিম বিক্রি বন্ধ রেখেছেন আড়তদারেরা। পাহাড়তলী ডিম আড়তদার সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল শুক্কুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত দিন সরবরাহকারীরা সরকারের নির্ধারিত মূল্যে ডিম সরবরাহ করবে না, তত দিন আমাদের আড়তও বন্ধ থাকবে।’
আড়তে বিক্রি বন্ধ থাকায় কিছু কিছু বাজারে তার প্রভাব পড়েছে। গতকাল দুপুরে ঢাকার কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, বেশির ভাগ দোকানে ডিম নেই। একটি দোকানে কিছু ডিম ছিল, তা তখনই বিক্রি হয়ে যায়।
দোকানটির ডিম বিক্রেতা ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফার্মের মুরগির যে ডিম দেখছেন, তা গতকালের (রোববার)। তা-ও কাঁঠালবাগান বাজার থেকে আনা হয়েছে। তেজগাঁও ডিমের আড়ত থেকে গত দুই দিনে কোনো ডিম কিনতে পারিনি।’
সূত্র জানিয়েছে, কিছু আড়তে কেনাবেচা বন্ধ থাকলেও বিকল্পভাবে ডিম সরবরাহ করা হচ্ছে। যদিও দাম চড়া।
এদিকে বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ডিমের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে সরবরাহ–সংকট বড় কারণ। দেশে দৈনিক ডিমের চাহিদা প্রায় সাড়ে চার কোটি। আগে দিনে সাড়ে চার-পাঁচ কোটির মতো ডিম উৎপাদন হতো। এখন তিন কোটির বেশি উৎপাদন নেই। এর প্রভাব পড়েছে বাজারে।
কারওয়ান বাজার পরিদর্শনে গিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘ডিমের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা গত দুই দিনে বসেছি। এ সপ্তাহে সংশ্লিষ্ট অন্যদের সঙ্গেও বসা হবে। পাশাপাশি ভারত থেকেও ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বাজার স্বাভাবিক করার জন্য চেষ্টায় কোনো গাফিলতি নেই।’
দুই মন্ত্রণালয়ের দুই রকম অবস্থান
ডিম, মুরগি ও গরুর মাংসের দাম নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দুই রকম অবস্থান দেখা গেছে। ঘাটতির সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমদানির পক্ষে। অন্যদিকে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় আমদানির বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে তারা খামারিদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি সামনে আনে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও অবস্থান আগের মতোই আছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রেয়াজুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ডিমের দাম বেড়েছে বাড়তি চাহিদা তৈরি হওয়ায়। সবজির দাম অনেক বেড়েছে। এ কারণে ডিমের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। শিগগিরই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
খামারমালিক খন্দকার মো. মহসিনের মত হলো, বাড়তি চাহিদা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি সরবরাহ কম। এর কারণ গরম, লোডশেডিং ও বন্যায় মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পোলট্রি খাদ্য ও অন্যান্য উপকরণ এবং মুরগির বাচ্চার উচ্চ দরের কারণে খামারিদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) গত জুলাইয়ে এক সমীক্ষা করে জানায়, ডিম, মুরগির বাচ্চা ও পোলট্রি খাদ্যের দাম ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে অনেকটাই বেশি। এর কারণ আমদানি কার্যত নিষিদ্ধ। সুরক্ষিত বাজারে উচ্চমূল্য রাখার সুযোগ তৈরি হয়।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সব পণ্যেই দেশীয় উৎপাদকদের নির্দিষ্ট মাত্রায় সুরক্ষা দিয়ে আমদানির সুযোগ রাখা দরকার, যাতে দেশীয় উৎপাদকেরা ইচ্ছেমতো দাম রাখার সুযোগ না পান। পোলট্রি খাদ্যের ক্ষেত্রে এ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে ভোক্তা ও খামারিদের স্বার্থ না দেখে পোলট্রি খাদ্য ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখার অভিযোগ রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, ‘বাজার সুরক্ষিত রেখে কাউকেই কারসাজি করার সুযোগ দেওয়া ঠিক নয়।’