সংস্কারে বিলম্ব, পিছিয়ে যাচ্ছে এফবিসিসিআইয়ের নির্বাচন
আড়াই মাসের বেশি সময় ধরে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ে কোনো পরিচালনা পর্ষদ নেই। সরকার নিযুক্ত প্রশাসক দৈনন্দিন কাজ চালিয়ে নিলেও ব্যবসায়ীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ফেডারেশন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। অন্যদিকে ফেডারেশনের সংস্কার কার্যক্রম চলছে ধীরগতিতে। সে কারণে নির্বাচন প্রক্রিয়াও শুরু হচ্ছে না। এদিকে প্রশাসকের নির্ধারিত মেয়াদও ফুরিয়ে আসছে।
ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বিভিন্ন কারণে এফবিসিসিআইয়ে সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে সংস্কার কার্যক্রম চলছে শ্লথগতিতে। অথচ সংস্কারের কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করে ফেডারেশনে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত করা দরকার। ফেডারেশনে ব্যবসায়ী নেতৃত্ব না থাকায় বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। মাসের পর মাস এভাবে চললে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়ার শঙ্কা আছে।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) পরিচালনা পর্ষদের পদত্যাগের দাবিতে তৎপর হন সদস্যদের একাংশ। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সভাপতি পদ থেকে মাহবুবুল আলম পদত্যাগ করেন। পরে ১১ সেপ্টেম্বর ফেডারেশনের পর্ষদ বাতিল করে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের সদস্য মো. হাফিজুর রহমানকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তাঁকে ১২০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করে নির্বাচিত পর্ষদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে বলা হয়। ইতিমধ্যে আড়াই মাস পার হলেও নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। যদিও নির্বাচন করতে কমপক্ষে ৯০ দিন সময় লাগে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এফবিসিসিআইয়ের সাধারণ পরিষদের সদস্যরা—এই ব্যানারে যাঁরা পর্ষদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন, পরে তাঁরাই এফবিসিসিআইয়ের বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদ গঠন করেন। তাঁরা গত সেপ্টেম্বরে মনোনীত পরিচালক প্রথা বাতিল, পর্ষদের সদস্য সংখ্যা কমানোসহ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাব দেয়। তারপর গত মাসে সব চেম্বার ও পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সংস্কার প্রস্তাব পাঠান প্রশাসক।
জানতে চাইলে এফবিসিসিআইয়ের সহায়ক কমিটির সদস্য ও বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা আবুল কাসেম হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে সংস্কার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেগুলো যুক্ত করে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা প্রকাশ করলে ফেডারেশন নিজেদের সংঘবিধি পরিবর্তন করবে। তারপরই নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এখনো ফেডারেশনের সংস্কার প্রস্তাবে হাতই দেয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সব চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন নেতারা ফেডারেশনের সংস্কার চান। সে জন্য তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে বিধিমালা নিয়ে আমরা বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বসব
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আবুল কাসেম হায়দার বলেন, ‘আমরা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি, কতটুকু গ্রহণ করবে সেটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সংস্কার হলেই আমরা নির্বাচনে চলে যাব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ীরা আছি বিপদে। ব্যবসায়ীদের কথা বলার কোনো জায়গা আপাতত নেই। সে কারণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন দরকার।’
সংস্কার প্রস্তাবে কী আছে
এফবিসিসিআই সংস্কারে ১২টি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন প্রশাসক। এতে ফেডারেশনসহ সব বাণিজ্য সংগঠনকে রাজনীতিমুক্ত করার পাশাপাশি সরাসরি ভোটের মাধ্যমে সভাপতি, সহসভাপতি ও পরিচালক নির্বাচনের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া ফেডারেশনের পরিচালকের সংখ্যা ৮০ থেকে কমানোর পাশাপাশি অফিস বেয়ারের পদ সর্বোচ্চ ৪ জনে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়। নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে এফবিসিসিআইসহ সব বাণিজ্য সংগঠনে পরপর দুবার পরিচালক নির্বাচিত হলে অন্তত একবার বিরতি দিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিধান করার সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রস্তাবে মনোনীত পরিচালকের বিধান বাতিলেরও সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, যদি মনোনীত পরিচালক রাখতেই হয়, তবে সেই সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। মনোনীত পরিচালকদের কোনো ভোটাধিকার থাকবে না। পাশাপাশি ফেডারেশনে প্রকৃত ব্যবসায়ী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সাধারণ পরিষদে সদস্য হওয়ার সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে।
বৈষম্যবিরোধী সংস্কার পরিষদের একাধিক সদস্য জানান, মনোনীত পরিচালক প্রথা বাতিল, পর্ষদ ৩৫-৪০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা, সরাসরি ভোটে সভাপতি, সহসভাপতি ও পরিচালক নির্বাচন, টানা দুবার পরিচালক হওয়ার পর একবার বিরতি—এমন কয়েকটি সংস্কার চান তাঁরা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত বছর খসড়া বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা করে। এতে বলা হয়, এফবিসিসিআইয়ের বর্তমানের ৮০ জনের পর্ষদ ৬৮ জনে নামবে। পাশাপাশি মনোনীত পরিচালকের সংখ্যাও ৩৪ থেকে কমে ৪ জন হবে। পর্ষদে একজন সভাপতি, একজন সিনিয়র সহসভাপতি এবং চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ থেকে তিনজন করে মোট ছয়জন সহসভাপতি হতে পারবেন।
১৯৬১ সালের বাণিজ্য সংগঠন অধ্যাদেশ বাতিল করে ২০২২ সালে নতুন বাণিজ্য সংগঠন আইন প্রণয়ন করে সরকার। নতুন বিধিমালা করা হচ্ছে এ আইনেরই ভিত্তিতে।
জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মোহাম্মদ নাভিদ শফিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ফেডারেশন থেকে একটি প্রস্তাব এসেছে। সেটি নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আগামী সপ্তাহে বাণিজ্য সংগঠন বিধিমালা নিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক হবে। তারপরই নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রশাসক যা বললেন
এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন নেতারা ফেডারেশনের সংস্কার চান। সে জন্য তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে সংস্কার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে বিধিমালা নিয়ে আমরা বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বসব। সেখানে ফেডারেশনের সংস্কারের বিষয়গুলোও আসবে।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি নিজেও চাচ্ছি দ্রুত নির্বাচন হোক। সংস্কার প্রক্রিয়ায় যদি খুব বেশি সময় লাগে, তাহলে আমরা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে দেব। তবে আমার মনে হয়, খুব বেশি বেশি সময় লাগবে না। কারণ, খসড়া বিধিমালা প্রস্তুত হয়ে আছে। সেখানে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করলেই হবে। তা ছাড়া বিধিমালা মন্ত্রণালয় অনুমোদন করলেই চলবে।’ তবে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রশাসকের মেয়াদ বাড়াতে হবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।