টিসিবির পণ্য: ক্রেতার সারি দীর্ঘ, ট্রাকে পণ্য কম
কম দামে চাল, ডাল, তেল ও আলু বিক্রি হচ্ছে—এমন খবর শুনে গতকাল বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে টিসিবি ভবনের সামনে আসেন গৃহকর্মী সীমা আক্তার। সেখানে ট্রাকে করে সাশ্রয়ী দামে পণ্য বিক্রি করছিল সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)।
প্রায় তিন ঘণ্টা সারিতে দাঁড়িয়ে পণ্য কেনার সুযোগ পান সীমা আক্তার। এসব পণ্য নিয়ে ফেরার পথে তিনি বলেন, ‘কষ্ট হইলেও অনেক টাকা ছাড়ে জিনিসগুলো কিনতাম পারছি।’ তবে টিসিবির ট্রাকের পেছনে সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকে শেষ পর্যন্ত পণ্য কেনার সুযোগ পাননি।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, মতিঝিলের নটর ডেম কলেজ ও বক চত্বর—এই চার স্থানে গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, টিসিবির ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ সময় সারিতে দাঁড়িয়ে থেকেও পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরে গেছেন অনেকে। কারণ, পণ্যের তুলনায় ক্রেতার সংখ্যা বেশি। গতকাল রাজধানীর ৫০টি স্থানে এভাবে পণ্য বিক্রি করে টিসিবি। প্রতিটি ট্রাকে ৩৫০ জনের জন্য পণ্য ছিল। তবে অধিকাংশ জায়গাতেই এর চেয়ে ১০০ থেকে ১৫০ জন বেশি মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
টিসিবির ট্রাক থেকে একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই লিটার ভোজ্যতেল, দুই কেজি মসুর ডাল, পাঁচ কেজি চাল ও তিন কেজি আলু কিনতে পারছেন। বাজারে সম্প্রতি আলুর দাম বেড়েছে। এ জন্য গতকাল থেকেই আলু বিক্রি শুরু করেছে টিসিবি। এসব পণ্যের মধ্যে প্রতি লিটার ভোজ্যতেল ১০০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৬০, চাল ৩০ টাকা ও আলু ৪০ টাকায় কেনা যায়। এই চার পণ্য কিনতে একজন গ্রাহককে দিতে হয় ৫৯০ টাকা। আর খুচরা বাজার থেকে এসব পণ্য কিনতে লাগে প্রায় ১ হাজার ৫০ টাকা, অর্থাৎ টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনলে অন্তত ৪৫০ টাকা সাশ্রয় হয়।
মূলত বাজার খরচ থেকে কিছু টাকা বাঁচাতেই দীর্ঘ সময় সারিতে দাঁড়ানোর কষ্ট করেন নিম্ন ও সীমিত আয়ের এসব মানুষ। টিসিবির ট্রাকের পেছনে গৃহকর্মী, রিকশাচালক ও দিনমজুরের উপস্থিতি ছিল বেশি। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিম্নস্তরের কর্মীদেরও সারিতে দাঁড়াতে দেখা গেছে। তাঁদের অনেকেই কাজ ফেলে বা স্বল্প সময়ের ছুটি নিয়ে পণ্য কিনতে আসেন।
দেশে দেড় বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। অক্টোবর মাসেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ আছে।
মূলত বাজার খরচ থেকে কিছু টাকা বাঁচাতেই দীর্ঘ সময় সারিতে দাঁড়ানোর কষ্ট করেন নিম্ন ও সীমিত আয়ের এসব মানুষ। টিসিবির ট্রাকের পেছনে গৃহকর্মী, রিকশাচালক ও দিনমজুরের উপস্থিতি ছিল বেশি।
‘সরকার দাম কমাই দেইক’
গতকাল বেলা একটায় শাহবাগে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন ভাড়ায় মোটরসাইকেলচালক রাকিব হাসান। এ সময় হঠাৎ সেখানে টিসিবির ট্রাক এলে তিনি সারিতে দাঁড়ান। রাকিব বলেন, ‘ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালিয়ে যে আয় হয়, তা দিয়ে এখন দিন চলা খুব কষ্টের। ট্রাক থেকে কম দামে পণ্য বিক্রি হচ্ছে দেখে আমিও লাইনে দাঁড়ালাম। এখান থেকে কিনলে যে টাকা বাঁচবে, তা দিয়ে মাছ-মুরগি কিছু একটা অন্তত কিনতে পারব।’
বেলা দুইটায় মতিঝিলের নটর ডেম কলেজের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে নারী-পুরুষের লম্বা সারি। তখন সেখানে ২১৫ জন (৯৭ জন পুরুষ ও ১১৮ জন নারী) সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অথচ ওই ট্রাকে আর ১৮০ জনের জন্য পণ্য অবশিষ্ট ছিল।
সরকার বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমাই (কমিয়ে) দেইক, তাইলে সবাই খাইতে পারমু। কিন্তু এভাবে মারপিট করে আর জিনিস নিতে পারতাম না।
নটর ডেম কলেজের সামনে অনেক ভিড় দেখে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছিলেন গৃহকর্মী হাজেরা বিবি। প্রথম আলোকে তিনি জানান, সকালে এক বাসায় কাজ করে এখানে এসেছেন। দেড় ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে আবার কাজে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু সারিতে যে পরিমাণ মানুষ আছে, তাতে পণ্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম, পেলেও অন্তত চারটা বেজে যাবে। তাই তিনি চলে যাচ্ছেন।
মতিঝিলের বক চত্বরে গতকাল বেলা তিনটার দিকে টিসিবির ট্রাকের পেছনে প্রায় তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে পণ্য কেনার সুযোগ পান গৃহিণী তাসলিমা আক্তার। এ সময় ধাক্কাধাক্কির কারণে শরীরে আঘাতও পান তিনি। তাসলিমা বলেন, ‘সরকার বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমাই (কমিয়ে) দেইক, তাইলে সবাই খাইতে পারমু। কিন্তু এভাবে মারপিট করে আর জিনিস নিতে পারতাম না।’
এ উদ্যোগের সম্প্রসারণ প্রয়োজন
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, ঢাকাসহ শহর এলাকাগুলোয় টিসিবির ট্রাক সেলসহ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাড়ানো প্রয়োজন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, দেড় বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। এমন পরিস্থিতিতে টিসিবির ট্রাক সেল কার্যক্রম শুরু এবং পণ্য তালিকায় আলু যুক্ত করার বিষয়টি ইতিবাচক। যেহেতু চাহিদার তুলনায় পণ্যের ঘাটতি রয়েছে, সে ক্ষেত্রে এ উদ্যোগের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। টিসিবির ট্রাকে করে বিতরণ এলাকা বৃদ্ধি এবং আরও বেশিসংখ্যক মানুষের জন্য পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে একটি স্থানে দুটি করে ট্রাক রাখা যেতে পারে।
শহরে টিসিবির ট্রাকের সংখ্যা ও পণ্যের পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় দেখে বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। ট্রাকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং একটি ট্রাকে করে ৩৫০ জনের বেশি ভোক্তাকে পণ্য দেওয়া—এই দুটো বিষয়ই আমরা পর্যালোচনা করছি। আশা করছি, এ বিষয়ে শিগগিরই একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
সরকার বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমাই (কমিয়ে) দেইক, তাইলে সবাই খাইতে পারমু। কিন্তু এভাবে মারপিট করে আর জিনিস নিতে পারতাম না।গৃহিণী তাসলিমা আক্তার
‘রমজানে মজুত ঠিক থাকবে’
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন জানিয়েছেন, আগামী রমজানে পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করতে তাঁরা কাজ করছেন। ফলে রমজানে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ঠিক থাকবে বলে আশা করছেন তিনি। গতকাল সকালে কারওয়ান বাজারে টিসিবির উদ্যোগে আলুসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রির কার্যক্রম উদ্বোধন শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা এ কথা বলেন।
শেখ বশিরউদ্দিন বলেন, ‘বাজারে নিত্যপণ্যের যে মূল্যস্ফীতি, সরবরাহব্যবস্থা উন্নত করার মাধ্যমে তার অনেকটা সমাধান করা সম্ভব। সরবরাহব্যবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে রাতদিন কাজ করছি। পণ্যের উৎপাদন, আমদানি ও মজুত নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করছি। এ বিষয়ে সবাই যথেষ্ট সংবেদনশীল রয়েছেন; ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও তদারকি কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছে।’
বাণিজ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, জিনিসপত্রের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্টের বিষয়ে সরকার অবগত। দাম কমানোর ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ চেষ্টা জারি আছে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও পরিমাণ আরও বাড়ানো গেলে দ্রুত দ্রব্যমূল্যে স্থিতিশীলতা আসবে।