ডিজিটাল লেনদেনে প্রতারণা বাড়ছে, যেভাবে নিরাপদ থাকবেন
ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে প্রতারকেরা ব্যাংক হিসাব, ক্রেডিট কার্ড অথবা মুঠোফোন থেকে টাকা নিয়ে নিতে পারে। মেনে চলুন পরামর্শ।
● সাধারণ সাইবার অপরাধের একটি ধরন হলো ‘পরিচয় চুরি’ বা আইডেনটিটি থেফট।
● ডিজিটাল লেনদেনে নিরাপদ থাকতে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললেই হয়।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম অবসরে গিয়েছেন কয়েক বছর আগে। সরকারি কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডে তিনি সহায়তার জন্য আবেদন করেছিলেন। সেই তথ্য জেনে যায় প্রতারকেরা। সঙ্গে তাঁর নানা ব্যক্তিগত তথ্যও প্রতারকদের হাতে চলে যায়।
রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, প্রতারকেরা তাঁকে সহায়তা দেওয়ার কথা বলে ক্রেডিট কার্ডের নম্বর নিয়ে নেয়। এরপর ১০ দফায় ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) নম্বর নিয়ে ১০টি লেনদেন করে। রফিকুল হারান প্রায় তিন লাখ টাকা।
ঘটনাটি ২০২২ সালের। ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধির সঙ্গে এভাবে প্রতারণাও বাড়ছে। প্রতারকেরা ধরা পড়ছে, মামলা হচ্ছে, কিন্তু প্রতারণা কমছে না। নিরাপত্তাবিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতারিত হওয়া ঠেকাতে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
ইস্টার্ণ ব্যাংকের হেড অব ইনফরমেশন সিকিউরিটি মো. আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, কিছু বিষয় মেনে চললে প্রতারণার শিকার হতে হয় না। গোপন নম্বর (পাসওয়ার্ড ও পিন) কাউকে বলা যাবে না, এটা মনে রাখতে হবে। তিনি বলেন, বিল পরিশোধের সময় চোখের সামনে যেন লেনদেন হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, কার্ড নকল (ক্লোন) করে অপরাধ ঘটছে। গ্রামপর্যায়ে এসব বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো দরকার।
বিশ্বজুড়ে সাধারণ সাইবার অপরাধের একটি ধরন হলো ‘পরিচয় চুরি’ বা আইডেনটিটি থেফট। ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে প্রতারকেরা ব্যাংক হিসাব, ক্রেডিট কার্ড অথবা মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) হিসাব থেকে টাকা নিয়ে নিতে পারে। এমনকি ব্যাংকঋণও নেওয়া হতে পারে।
উৎসব-পার্বণে মানুষের কেনাকাটা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। প্রযুক্তির প্রসারে শহরের মানুষ ডিজিটাল লেনদেনেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজেদের গ্রাহকের জন্য নানা অফার দিয়ে থাকে। এ সময় ওত পেতে থাকা প্রতারকেরাও মানুষকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে।
ডিজিটাল লেনদেনে নিরাপদ থাকার বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রথম কথাই হচ্ছে, লোভকে সংবরণ করুন। একটু সচেতনতা, কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললেই নির্বিঘ্নেই ‘ক্যাশলেস’ লেনদেন চালিয়ে যাওয়া যায়।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল দেশের আর্থিক খাতের জ্যেষ্ঠ একজন বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কিছু পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশে ব্যাংক কার্ডে প্রতারণা তুলনামূলক কম। তবে ফোন করে, বার্তা পাঠিয়ে লোভের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা হয়। এই ফাঁদে যাঁরাই পা দিয়েছেন, তাঁরাই বিপদে পড়েছেন। তিনি বলেন, মুঠোফোনে বার্তার মাধ্যমে অথবা ই-মেইলের মাধ্যমে অনেক সময় ‘ফিশিং লিংক’ পাঠানো হয়। সেখানে ক্লিক করলে অনেক সময় ব্যক্তিগত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেহাত হয়। আর্থিক তথ্যও প্রতারকের হাতে চলে যায়।
অনেকে ব্যাংকের হিসাব নম্বর, পাসওয়ার্ড ও মুঠোফোনে আর্থিক সেবার (বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি) পাসওয়ার্ড লিখে রাখেন। সেটি কখনোই করা ঠিক নয়। কাগজে লিখে পকেটে রাখলেও ঝুঁকি আছে। মনে রাখাই ভালো। মনে রাখতে না পারলে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার অ্যাপ ব্যবহার করুন। সেটা বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানের তৈরি হতে হবে।
বড়দের মুঠোফোন, ট্যাব ও ল্যাপটপ এখন শিশুরাও ব্যবহার করে। এসব ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাচ্চাদের খুব সহজেই ভোলানো যায়। তাদের কাছ থেকে ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম নিয়ে অভিভাবকদের প্রতারণার শিকারে পরিণত করা কঠিন নয়। ইলেকট্রনিক সরঞ্জামগুলো ই-মেইল দিয়ে চালু করা হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ই-মেইল ‘লগ ইন’ করা থাকে। শিশুরা ভুলে কোথাও ক্লিক করে ফেললে তথ্য বেহাতের আশঙ্কা থাকে। পরামর্শ হলো, শিশুদের ব্যবহারের জন্য ইলেকট্রনিক সরঞ্জামে আলাদা ‘প্রোফাইল’ করে দিতে হবে।
দুর্বল পাসওয়ার্ড ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। পাসওয়ার্ড ১৪ থেকে ১৬ অঙ্কের হতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আসা লেনদেন–সংক্রান্ত বার্তা ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোরও গ্রাহকদের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। গ্রাহক যেন নিয়ম করে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করেন, সেটি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া জরুরি।
কার্ডে কেনাকাটা করতে গেলে পিন দেওয়া ও ‘সোয়াইপ’ করার পাশাপাশি স্পর্শের মাধ্যমেই বিল পরিশোধ করা যায়। যেটাকে বলে এনএফসি (নিয়ার ফিল্ড কমিউনিকেশন)। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাধারণত স্বল্প পরিমাণের লেনদেনে এনএফসি ব্যবহার করা হয়। টাকার অঙ্ক বেশি হলে সে ক্ষেত্রে পিন দেওয়ার পদ্ধতি থাকে। বাংলাদেশে বছরখানেক আগে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত এনএফসি লেনদেনের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
মুঠোফোনে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের নামে কয়েক দফা ফোন পাওয়ার কথা জানিয়ে পুরান ঢাকার দোকানকর্মী জিহাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখনই ওটিপি নম্বর চায়, তখনই বুঝতে পারি প্রতারকের ফোন। নম্বর আর দিইনি।’ তিনি বলেন, ‘ওটিপি নম্বর যে দিতে হয় না, সেটি জানি বলে কয়েক দফা প্রতারণা থেকে বেঁচে গেছি।’