বড় হচ্ছে সুপারশপের ব্যবসা
বিভিন্ন পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ক্ষেত্রবিশেষে সুপারশপের ক্রেতারা কেনাকাটার পরিমাণ ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছেন।
এক ছাদের নিচে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রয়োজনীয় সব ধরনের নিত্যপণ্য পাওয়ায় শহরে সুপারশপগুলো দিন দিন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাতে রিটেইল বিজনেস (খুচরা বিক্রি) খ্যাত সুপারশপগুলোর ব্যবসা বড় হচ্ছে। তাতে তাদের মুনাফায়ও গতি এসেছে। তবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ নানা কারণে এ খাতের প্রবৃদ্ধি ধাক্কা খেয়েছে বলে দাবি করেন উদ্যোক্তারা।
দেশে ২০০০ সালের পর থেকে সুপারশপের ব্যবসা শুরু হলেও ভোক্তাদের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পেতে এক দশকের বেশি সময় লেগে যায়। তবে গত কয়েক বছরে নগরজীবনে সুপারশপে কেনাকাটা করা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে করোনাকালে এ ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটে। একই ছাদের নিচে কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য সব পণ্য পাওয়া যায় বলে ভোক্তাদের কাছে সুপারশপের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে।
গ্রাহক খুব একটা না কমলেও বিক্রি কমেছে। আগে যাঁরা দুই হাজার টাকার বাজার করতেন, তাঁরা এখন এক হাজার টাকার বাজার করছেন।
দেশে নিত্যপণ্যের বাজারটি কত বড়, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ সুপারমার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের অনুমান, বর্তমানে দেশে নিত্যপণ্যের খুচরা বাজারের আকার প্রায় দেড় হাজার কোটি মার্কিন ডলারের। এর মধ্যে সুপারশপের হিস্যা মাত্র দুই থেকে আড়াই শতাংশ, যা বছর তিনেক আগেও ছিল দেড় শতাংশের কম। দুই বছর ধরে সুপারশপ ব্যবসায় ২৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ না থাকলে তা আরও ১০ থেকে ২০ শতাংশ বেশি হতো। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে সুপারশপের বাজার ১৯০ কোটি ডলার ছাড়াবে বলে আশা এই খাতের ব্যবসায়ীদের।
সুপারমার্কেট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গত তিন-চার বছরে দেশে সুপারশপ ব্যবসায় অনেক গতি এসেছে। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভালো মুনাফাও করেছে। ফলে সুপারশপের ধারণা রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের পাশাপাশি জেলা-উপজেলা পর্যায়েও পৌঁছে যাচ্ছে।
বাড়ছে সুপারশপের সংখ্যা
সুপারশপের উদ্যোক্তারা বলেন, দেশে দ্রুত নগরায়ণ বাড়ছে। বিশেষ করে পূর্বাচল, কেরানীগঞ্জ, বছিলাসহ রাজধানীর আশপাশে ও বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে পরিকল্পিতভাবে নতুন আবাসিক এলাকা গড়ে উঠছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে অর্থনৈতিক অঞ্চল, হাইটেক পার্ক, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) মতো বৃহৎ প্রকল্প ও শিল্পাঞ্চল বাস্তবায়িত হচ্ছে। ফলে এসব এলাকাকে ঘিরে সুপারশপের চাহিদা বাড়ছে। আবার কেনাকাটার ক্ষেত্রে ভোক্তাদের আচরণ ও জীবনযাপনেও পরিবর্তন এসেছে। তাতেও সুপারশপের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সুপারশপ ডেইলি শপিংয়ের মূল প্রতিষ্ঠান প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ভোক্তারা এখন সাচ্ছন্দ্যে দৈনন্দিন কেনাকাটা করতে চান। এ জন্য সুপারশপের প্রতি তাঁদের আগ্রহ বাড়ছে। ফলে সুপারশপের সংখ্যাও বাড়ছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে সারা দেশে দেড় হাজারের বেশি সুপারশপ রয়েছে। এর মধ্যে চেইন সুপারশপ আছে ছয় শতাধিক। বাকিগুলো একটি বা দুটি বিক্রয়কেন্দ্র নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে বা এলাকাভিত্তিক ব্যবসা করছে। তবে পাঁচ বছর আগেও সুপারশপের সংখ্যা ছিল কয়েক শ। দেশের বড় চেইন সুপারশপগুলোর মধ্যে রয়েছে আগোরা, স্বপ্ন, মীনা বাজার, ডেইলি শপিং, ইউনিমার্ট, আলমাস, প্রিন্স বাজার, ডেইলি সুপারশপ (ডিসিসি) প্রভৃতি।
সুপারশপগুলোর মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে স্বপ্ন। সারা দেশে প্রতিষ্ঠানটির ৪৪০টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। স্বপ্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। অন্য সুপারশপগুলোর মধ্যে ডেইলি শপিংয়ের ৭৫টি, মীনা বাজারের ৩৩টি, আগোরার ২৩টি, আমানা বিগ বাজারের ১০টি, ইউনিমার্টের ৫টি ও প্রিন্স বাজারের ৫টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। আকারভেদে সুপারশপগুলোয় ৮ থেকে ৫০ হাজার বা তারও বেশি ধরনের পণ্য পাওয়া যায়। এসব জায়গায় লেনদেনের ৬৫ শতাংশ নগদ টাকায় আর বাকি ৩৫ শতাংশ কার্ড বা এমএফএসের মাধ্যমে হয়ে থাকে।
মূল্যস্ফীতির প্রভাব বেচাকেনায়
২০২৩ সালের প্রায় পুরো সময়ই দেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও ছিল অনেক বেশি। ব্যবসায়ীরা বলেন, সুপারশপের ভোক্তারা নিম্নবিত্ত না হলেও মূল্যস্ফীতির কারণে তাঁদের বড় একটি অংশ চাপে রয়েছে। প্রিন্স বাজারের চেয়ারম্যান কাজী রুহুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহক খুব একটা না কমলেও বিক্রি কমেছে। আগে যাঁরা দুই হাজার টাকার বাজার করতেন, তাঁরা এখন এক হাজার টাকার বাজার করছেন।
সুপারশপ স্বপ্নের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির কারণে ক্ষেত্রবিশেষে ক্রেতারা কেনাকাটার পরিমাণ ১০ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিয়েছেন। অন্যথায় আমাদের পরিচালন মুনাফা আরও অনেক বেশি হতো। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সুপারশপের ভোক্তারা আরও ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটবেন।’
মূল্যস্ফীতি ছাড়া ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণেও ঋণপত্র (এলসি) খুলে পণ্য আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। এতে সার্বিকভাবে সুপারশপের ব্যয় বেড়েছে আর মুনাফায় প্রবৃদ্ধি কমছে। অন্যদিকে সুপারশপে কেনাকাটায় ক্ষেত্রবিশেষ বর্তমানে ৪ থেকে ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এ কারণে অনেক ভোক্তা সুপারশপ থেকে পণ্য কিনতে আগ্রহী হন না। সে জন্য খাতের ব্যবসায়ীরা ভ্যাটকে আরও সামঞ্জস্যপূর্ণ করার দাবি জানান।
সুপারশপ মীনা বাজারের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আহমেদ সোয়েব ইকবাল বলেন, সুপারশপ এখন মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি পণ্যের একচেটিয়া দাম নিয়ন্ত্রণেও কার্যকর ভূমিকা রাখছে। তবে বাইরের বাজারের সঙ্গে ভ্যাটসহ অন্যান্য বিষয়ে সমান সুযোগ থাকলে এ ব্যবসা আরও সম্প্রসারিত হবে।