ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’-এর জেরে সাত বছর পর আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম বেড়ে ১০০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। একই কারণে বিশ্বব্যাপী শেয়ারের দর এবং সূচকের পতনও অব্যাহত রয়েছে। সেই সঙ্গে সোনার দামও বাড়তে শুরু করেছে।
আজ বৃহস্পতিবার ইউরোপে আগাম কেনাবেচায় প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড জ্বালানি তেলের (৪২ মার্কিন গ্যালন বা ১৫৯ ব্রিটিশ লিটার) দাম ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে ১০২ দশমিক ৩২ ডলারে উঠেছে। এটি ২০১৪ সালের পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের সর্বোচ্চ দাম। গতকাল বুধবার প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ৯৯ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। আর যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারিমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) তেল ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৭ ডলারে উন্নীত হয়েছে। গতকাল প্রতি ব্যারেল ডব্লিউটিআই তেল ৯৬ ডলার পর্যন্ত উঠে আবার কমেছিল।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও বেড়েছে। আজ প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম এরই মধ্যে ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া সেইফ হ্যাভেন বা নিরাপদ বিনিয়োগ খ্যাত সোনার দামও ঊর্ধ্বমুখী। পণ্যটির আউন্সপ্রতি দাম ১ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৯৪২ ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম আরও বাড়বেো—এমন আশঙ্কা এখন প্রবল। সিএমসি মার্কেটসের বিশ্লেষক টিনা টেং বলেছেন, দাম আরও বাড়বে।
সামরিক হামলা শুরু করার আগে ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার সেনা মোতায়েনের পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান প্রভৃতি দেশ চাপ সৃষ্টি করতে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দেয়। তাতে কোনো কাজই হয়নি। কারণ, রাশিয়া না থেমে বরং গত রাতভর পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে (দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক) হামলা চালিয়েছে। ইউক্রেনের ওই অঞ্চলটি রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। রাশিয়া গত সোমবার অঞ্চল দুটিকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়।
শুধু তা–ই নয়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং জাপানা ও অস্ট্রেলিয়ার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ও বিরোধিতাকে পাত্তা না দিয়ে রাশিয়া পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্ববাজারে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে দিতে পারে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে দ্বিতীয় বৃহত্তম বা ১০ শতাংশ জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক হলো রাশিয়া। সবচেয়ে বেশি পরিমাণ তেল রপ্তানি করে সৌদি আরব।
পশ্চিমা দুনিয়ার প্রবল বিরোধিতার মধ্যেই রাশিয়া সম্প্রতি ইউক্রেন সীমান্তে দুই লাখ সেনা মোতায়েন করে। রুশ পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বিদেশে সৈন্য ব্যবহারের অনুমতি দেয়। এরই মধ্যে রাশিয়া পরমাণু অস্ত্রের মহড়া শুরু করে। পুতিন গত পরশু বেলারুশের নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোকে পাশে নিয়ে কম্পিউটারে যৌথ পরমাণু মহড়া দেখেন। কম্পিউটারের পর্দায় তারা জাহাজ, বিমান ও ডুবোজাহাজ থেকে নির্ভুল দক্ষতায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে পরমাণু অস্ত্রের আঘাত হানার দৃশ্য পর্যবেক্ষণ করেন।
এদিকে ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্টসহ পশ্চিমা দেশগুলোর তিক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় বৈশ্বিক শেয়ারবাজারে তৃতীয় দিনের মতো এশিয়ার শেয়ারবাজারে সূচকের পতন ঘটেছে। এর মধ্যে জাপানের জাপানের টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জের নিক্কেই ২২৫ সূচক ১ দশমিক ৮১ শতাংশ ও হংকংয়ের হেংসেং সূচক ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ কমেছে।
এই লেখা তৈরি করার সময় পর্যন্ত ইউরোপ-আমেরিকার শেয়ারবাজারে আজকের লেনদেন শুরু হয়নি। তবে গতকাল বুধবার যুক্তরাজ্যের এফটিএসই ২৫০ সূচক শূন্য দশমিক ৭২ শতাংশ, নেদারল্যান্ডসের এইএক্স সূচক শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ, প্যারিসের সিএসি ৪০ সূচক শূন্য দশমিক ১০ এবং ফ্রাঙ্কফুর্টের ড্যাক্স সূচক শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ কমেছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ডাউজোন্স সূচক ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ, এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচক ১ শতাংশ ৮৪ শতাংশ ও নাসড্যাক ২ দশমিক ৫৭ শতাংশ কমেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২০ শতাংশ, বর্তমান ফেব্রুয়ারিতে ১০ শতাংশ ও গত বছরের এই সময়ের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেড়েছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যানের পূর্বাভাস হচ্ছে, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতি ব্যারেল জ্বালানি তেলের দাম ১২৫ ডলারে এবং আগামী ২০২৩ সালে ১৫০ ডলারে উঠতে পারে। এর আগে ২০০৮ সালে জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ১৪৭ ডলারে উঠেছিল, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। সূত্র: বিবিসি, আনন্দবাজার পত্রিকা, সিএনবিসি।