কথায় আছে, সোনা কিনে রাখলেই লাভ। কারণ, সোনার ক্ষয় নেই, তাই ক্ষতির ঝুঁকিও নেই। ধরে রাখলেই লাভ। বাংলাদেশের বাজার হোক কিংবা আন্তর্জাতিক বাজার—কখনোবা সোনার দাম পড়ে গেলেও কম সময়ের মধ্যে তা আবার ঠিকই ঘুরে দাঁড়ায়। আর সংকটের সময় হলে তো কথাই নেই। বিশ্ববাজারে সোনার দাম চাঙা হবেই হবে, যেমনটি দেখা গেছে বিদায়ী বছরে।
২০২০ সালে যখন বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়-বাণিজ্যে স্থবিরতা, অর্থনীতি বিপর্যস্ত, প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক, মন্দায় নাকাল বহু দেশ, সাধারণ মানুষ আয়-রোজগারহীন, জ্বালানি তেলসহ অতি প্রয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম নিম্নমুখী; তখনই কিনা সোনার মতো বিলাসী পণ্যের দাম হু হু করে বেড়েছে। এভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে স্রোতের বিপরীতে সোনার দাম চাঙা হওয়ার প্রভাব বাংলাদেশের বাজারেও পড়েছে।
অতীত হতে যাওয়া এই বছরে বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্সে (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দাম ৩৬৬ ডলার বা ২৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক বাজারে যেখানে প্রতি আউন্স সোনা বিক্রি হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫১৫ মার্কিন ডলারে, সেখানে ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৮৬ ডলারে।
এদিকে বাংলাদেশের বাজারে প্রতি ভরিতে সোনার দাম ১৭ হাজার ৪৭২ টাকা বা ৩১ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেড়েছে। গত বছর দেশের বাজারে ভরিপ্রতি সোনার সর্বশেষ দাম ছিল ৫৫ হাজার ১৯৫ টাকা। ২০২০ সাল শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৭২ হাজার ৬৬৭ টাকা।
বিশ্ববাজারে সোনার চাহিদা কমেছে ১৯ শতাংশের মতো। তবে জুয়েলারি বা স্বর্ণালংকারের চাহিদা কমেছে আরও বেশি, ২৯ শতাংশ। অন্যদিকে সোনায় বিনিয়োগ বেড়েছে ২১ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক বাজারে সোনা আউন্স হিসেবে আর দেশের বাজারে ভরি হিসেবে বিক্রি হয়। ২৮ দশমিক ৩৫ গ্রামে এক আউন্স, আর ১১ দশমিক ৬৬ গ্রামে হয় এক ভরি।
দেশের বাজার
দেশে ২০২০ সালে বেশ কয়েকবার সোনার দাম বেড়েছে। যেমন ২৩ জুন সোনার দাম ভরিতে ৫ হাজার ৮২৫ টাকা, ২৪ জুলাই ২ হাজার ৯১৬ টাকা এবং ৬ আগস্ট ৪ হাজার ৪৩৩ টাকা বৃদ্ধি করে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)। তারপর দুই দফায় অবশ্য কমে ৪ হাজার ৯৫৮ টাকা।
কখনো দাম বাড়ানো হয়েছে বাংলাদেশি নাগরিকদের সোনা কেনার অন্যতম মুদ্রা মার্কিন ও সিঙ্গাপুরি ডলার এবং দিরহামের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার বিনিময় হার কিছুটা দুর্বল হওয়ায়। করোনাকালে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বা বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় ব্যাগজ রুলসের আওতায় সোনা আসছে—এই যুক্তিতে বাড়ানো হয়। চীন–যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে মার্কিন ডলারের দাম কমা, তেলের দরপতন ও পর্যাপ্ত আমদানির অভাব—এসব অজুহাত দেখিয়েও দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ানো হয়েছে।
আবার আন্তর্জাতিক বাজারে দর না বাড়লেও দেশে একাদিক্রমে বাড়িয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি। একবার তো বিশ্ববাজারে না বাড়লেও দেশের বাজারে সোনার দাম ভরিতে ২ হাজার ৪৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট বিশ্ববাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ২ হাজার ডলার ছুঁয়ে যায়। তখনই জুয়েলার্স সমিতি দেশের বাজারে ভরিতে ৪ হাজার ৪৩৩ টাকা বৃদ্ধি করে। তাতে প্রতি ভরির দাম দাঁড়ায় ৭৭ হাজার ২১৬ টাকা। এটিই দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দাম।
বিশ্ববাজার
ঐতিহাসিক সত্য হলো, সংকট ও অনিশ্চয়তার সময়ই মূলত সোনার দাম বাড়ে। সেই ১৯৩০–এর মহামন্দার সময় থেকেই এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ১৯৭০–এর সংকটের সময় সোনার দর আউন্সপ্রতি ৩৫ ডলার বেড়ে ৫২৫ ডলার হয়েছিল। ১৯৮০ সালের সংকটের সময়ে দাম বেড়ে ৬১৫ ডলারে ওঠে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের জেরে ২০১১ সালে সোনার দর অনেক বেড়ে ১ হাজার ৯০০ ডলারে ওঠার রেকর্ড হয়েছিল।
ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ২০২০ সালের ৬ আগস্ট বিশ্ববাজারে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ২ হাজার ৬৭ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
গোল্ডম্যান স্যাকসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রভাব দীর্ঘায়িত হওয়ার শঙ্কা থাকায় নতুন বছরেও বিশ্ববাজারে সোনার দাম আরও বাড়বে।