বিশ্ববাজারে অস্থিরতা, দেশে দুশ্চিন্তা
দেশের বাজারে সয়াবিন তেলের দাম যখন এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ, তখন আরও দুশ্চিন্তাজনক খবর দিচ্ছে বিশ্ববাজার। রপ্তানিকারক দেশগুলোতে বাড়ছে চাল, চিনি, গম, ডাল ও গুঁড়াদুধের মতো বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। রান্নার গ্যাস ও যানবাহনের জ্বালানির দরও বাড়তির দিকে।
অস্থির শিল্পপণ্যের বাজারও। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। গত জুলাইয়ে বিশ্ববাজারে এক মেট্রিক টন প্লাস্টিক দানার দাম ছিল ৯০০ মার্কিন ডলার। ফেব্রুয়ারির শেষে তা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এর ফলে আগামী দিনগুলোতে প্লাস্টিকের বালতি কিনতেও বাড়তি দাম দিতে হতে পারে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে রডের কাঁচামাল পুরোনো লোহার দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সিমেন্ট তৈরির মূল উপকরণ ক্লিংকার, তুলা, সার, পশু ও মুরগির খাবার, কাঠ, অ্যালুমিনিয়াম ও টিন—কোথাও স্বস্তি নেই।
শুধু দাম নয়, পণ্যগুলো আমদানিতে এখন জাহাজভাড়াও বেশি লাগছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, দেশ ও দূরত্বভেদে জাহাজে কনটেইনার ভাড়া বেড়েছে ৩৩ থেকে ১২২ শতাংশ পর্যন্ত। বাড়তি ভাড়ার কারণে মোটরসাইকেল, গাড়ি, কৃষি যন্ত্রপাতির মতো বিভিন্ন পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও) বলছে, বিশ্বে খাদ্য মূল্যসূচক টানা নয় মাস ধরে বাড়ছে, যা ফেব্রুয়ারি মাস শেষে ১১৬ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এর আগে এই মূল্যসূচক সবচেয়ে বেশি ছিল ২০১৩ সালে। মূল্যবৃদ্ধির কারণ কী? তা গত মাসে এক প্রতিবেদনে তুলে ধরে মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যান চেজ। তারা বলছে, করোনাভাইরাস বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যে মন্দা তৈরি করেছিল, টিকা এসে যাওয়ায় তা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর বড় সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর ফলে পণ্য বাজারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া বাজারে অর্থপ্রবাহের ক্ষেত্রে বড় অর্থনীতিগুলোর অধিক উদারনীতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও দুর্বল ডলারও পণ্যের দাম বাড়ার কারণ।
বিশ্ববাজারের বর্তমান পরিস্থিতিকে ২০০৮ ও ২০১১ সালের সঙ্গে তুলনা করলেন চট্টগ্রামের সিকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক, যাঁদের ভোজ্যতেল, গম, সিমেন্ট, গ্যাস, প্লাস্টিক, প্রাণিখাদ্যসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সর্বশেষ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। এবারও সে রকম আশঙ্কাই দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষ বিপদে পড়বে। ঝুঁকি রয়েছে ব্যবসায়ীদেরও। কারণ ২০০৮ সালে বিশ্ববাজারে অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের অনেক আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান লোকসানে পড়ে। এরপর তারা আর টিকে থাকতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব পণ্যের দাম বাড়তি, তার মধ্যে বাংলাদেশ ভোজ্যতেল, চিনি, গম, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) এবং শিল্পের বেশির ভাগ কাঁচামালের জন্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল। চিনির মতো পণ্যের দাম বাড়লে মানুষের সংসার খরচ সরাসরি বাড়ে। আর শিল্পপণ্য পরোক্ষভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায়। যেমন মুরগির খাবারের দর বাড়লে মুরগির দাম বেড়ে যায়। দেশের বাজারে এক মাসে কেজিতে ১০০ টাকা বেড়ে সোনালিকা মুরগির দর ৩২০ টাকায় উঠেছে, যার একটি কারণ হিসেবে খাদ্যের দামকেও দায়ী করছেন খামারিরা। আবার তুলার চড়া দামের কারণ আগামী পবিত্র ঈদুল ফিতরে পোশাকের দাম বেড়ে যেতে পারে।
সব মিলিয়ে বিশ্ববাজার পরিস্থিতি নিয়ে সরকারও কিছুটা উদ্বেগে রয়েছে। বাণিজ্যসচিব মো. জাফরউদ্দীন গতরাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববাজার পরিস্থিতি আমরা পর্যবেক্ষণে রাখছি। সেখানে আমদানিনির্ভর পণ্যগুলোর দাম বাড়তির দিকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত পণ্যগুলোর স্থানীয় বাজার পরিস্থিতি নিয়ে এ মাসের মাঝামাঝি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে বৈঠক হবে।’
রোজার মাস ঘিরে দুশ্চিন্তা
রমজান শুরু হবে আগামী মাসে, অর্থাৎ এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রোজায় বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে কারণ ছাড়াই পণ্যের দাম বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। এর মধ্যে বিশ্ববাজার পরিস্থিতিকে অজুহাত হিসেবে দেখানোর চেষ্টা থাকতে পারে।
বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কতটুকু বেড়েছে, তার একটি চিত্র তুলে ধরা যাক। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ৮২১ ডলার থেকে বেড়ে ১ হাজার ৩২, চিনি ২৭১ ডলার থেকে বেড়ে ৩৬০ এবং গম ২১৩ থেকে বেড়ে ২৭৭ ডলার হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত অক্টোবরে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করা গম খালাস হয় প্রতি টন ২২২ থেকে ২৩৩ ডলারে (জাহাজ ভাড়াসহ)। জানুয়ারিতে রাশিয়ার গমের দাম পড়েছে প্রতি টন ২৯০ ডলার।
রোজার মাসে মসুর ডাল ও ছোলার চাহিদা বেড়ে যায়। চার মাসের ব্যবধানে এই দুই ধরনের ডালের দাম টনপ্রতি ১০০ ডলারের বেশি বেড়েছে বলে দাবি আমদানিকারকদের। তাঁরা বলছেন, প্রতি টন ছোলার দাম ৬৩০ ও মসুর ডালের দাম ৬৫০-৬৮০ ডলারে উঠেছে। গুঁড়াদুধের দাম পর্যবেক্ষণকারী ওয়েবসাইট গ্লোবাল ডেইরি ট্রেডের হিসাবে, গত নভেম্বরেও গুঁড়াদুধের টনপ্রতি দাম ৩০০০ ডলারের নিচে ছিল। ফেব্রুয়ারিতে তা ৪ হাজার ৩০০ ডলার ছাড়িয়েছে।
দেশের বাজারে ইতিমধ্যে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে ব্যবসায়ীরা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে আরও ৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। দুই মাসে চিনির দাম কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৬৫-৭০ টাকা হয়েছে। আটা ও ময়দার দামও সামান্য বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সরকার শুল্ক কমিয়ে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়ার পরও কমেনি চালের দাম।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আরএম এন্টারপ্রাইজের মালিক শাহেদ উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে ভোজ্যতেল, চিনি ও মটর ডালে। বিশ্ববাজারে বাড়লেও আমদানি বেশি বলে গমের দাম কিছুটা কম। তিনি বলেন, অন্য পণ্যের দাম এখনো স্থিতিশীল। তবে বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশেও প্রভাব পড়ে।
রড-সিমেন্টের দাম বাড়তি
দেশে রডের মূল কাঁচামাল পুরোনো লোহা। এর দাম বাড়তে শুরু করে গত নভেম্বরে। সে সময় প্রতি টন পুরোনো লোহার টুকরার (এইচএমএস) দাম ছিল ৩১০ ডলার। গত মাসে উঠেছে ৪৫৫ ডলারে। দেশের বাজারে প্রতি টন রডের দাম কয়েক দফায় ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা বেড়ে ৬৫-৬৭ হাজারে উঠেছে।
সিমেন্টের দাম এত দিন স্থিতিশীলই ছিল। বিশ্ববাজারে মূল কাঁচামাল ক্লিংকারের দাম বেড়ে যাওয়ায় কয়েকটি কোম্পানি সিমেন্টের বস্তাপ্রতি দাম ১০ টাকার মতো দাম বাড়িয়েছে। পণ্যের দামের বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও আমদানিকারক সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাইয়ে বিশ্ববাজারে ক্লিংকারের টনপ্রতি দাম ছিল ৩৮ ডলার। এখন তা ৫০ ডলার ছাড়িয়েছে।
জ্বালানির বাজারও অস্থির
রান্নার জন্য দেশের বহু পরিবার এখন এলপিজির ওপর নির্ভরশীল। জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এলপিজির দাম গড়ে প্রায় ৩৮ শতাংশ বেড়েছে। দেশেও দাম কিছুটা বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো।
মহামারির ধাক্কায় গত বছর এপ্রিলে প্রতি ব্যারেল অশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে কমে যায়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, গত এপ্রিল-জুন সময়ে বিশ্ববাজারে অশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ছিল ৩১ ডলার, যা ফেব্রুয়ারিতে গড়ে ৬২ ডলারে উঠেছে। অবশ্য দেশে জ্বালানি তেলের দাম নির্ভর করে সরকারের ওপর। বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে গেলে সরকারকে জ্বালানিতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে অথবা দাম বাড়াতে হবে।
জাহাজভাড়ায় রেকর্ড
বাংলাদেশ জাহাজে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে চীন থেকে। আমদানিকারক ও সমুদ্র পরিবহন কোম্পানি সূত্র জানিয়েছেন, এখন চীনের সাংহাই থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত ২০ ফুটের একটি কনটেইনারের ভাড়া লাগছে ১ হাজার ৭৮০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত, যা করোনার আগে ৮০০ ডলারের আশপাশে ছিল।
জাহাজভাড়া হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলো বলছে, করোনার শুরুর দিকে মন্দার কারণে বড় জাহাজ কোম্পানিগুলো নিজেদের বহরে থাকা ভাড়া জাহাজ ছেড়ে দেয়। একই সময়ে সমুদ্রপথে সক্রিয় জাহাজ ছিল কম। এতে কনটেইনারের সংকট দেখা দেয়। এখন হঠাৎ চাহিদা বেড়ে গেছে। তাই জাহাজভাড়াও বাড়তি।
খাতুনগঞ্জের আমদানিকারক ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চীন, ভারত ও দুবাই থেকে বাংলাদেশে পণ্য আমদানিতে আগে যে ব্যয় হতো, এখন তা দ্বিগুণ। কিছু ক্ষেত্রে পণ্যের দাম না বাড়লেও শুধু জাহাজভাড়ার কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে।
‘পরিস্থিতি নজরে রাখতে হবে’
দেশের দুই বড় পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার মৌলভীবাজারে পণ্যের দাম ওঠানামা করে বিশ্ববাজারের ওপর। এ দুটি বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন অনলাইনে বিশ্ববাজার পরিস্থিতি দেখে লেনদেন করেন। তার প্রভাব পড়ে খুচরা বাজারের ওপর।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে অস্থিরতার কারণে কেউ যাতে বাড়তি সুযোগ নিতে না পারে, তা পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার। এখন প্রতি সপ্তাহে আমদানি, সরবরাহ ও মজুত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, সীমিত আয়ের মানুষের জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করে বিস্তৃত পরিসরে বিক্রি করতে হবে। সরকারের অন্যান্য কর্মসূচিও এ সময় চালাতে হবে।
অবশ্য একটি ভালো খবরও দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, দেশে বোরো ধানের আবাদ ভালো হয়েছে। মে মাস নাগাদ নতুন চাল বাজারে আসতে শুরু করবে। আর দেশে মৌসুম শুরু হওয়ায় পেঁয়াজ ও রসুন নিয়ে রোজার বাজারে চিন্তার কারণ নেই। রোজায় বেগুন, শসা, কাঁচা মরিচ প্রভৃতির দামও তুলনামূলক কম থাকবে।