খুলে গেল বিদেশে বিনিয়োগের দুয়ার

বিনিয়োগকৃত টাকা ও লভ্যাংশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশে ফেরত আনতে ব্যর্থ হলে তা মানি লন্ডারিং অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ উন্মুক্ত করেছে সরকার। আর এ জন্য প্রথমবারের মতো অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ একটি বিধিমালা জারি করেছে। এত দিন বিশেষ বিবেচনায় বা কেস টু কেস ভিত্তিতে কিছু কোম্পানি বিদেশে বিনিয়োগ করলেও এ ব্যাপারে সরকারের আনুষ্ঠানিক কোনো বিধিমালা ছিল না। আগ্রহীদের আবেদনের বিপরীতে বিনিয়োগের অনুমোদন দিত বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে বিদেশে বিনিয়োগের এ সুযোগ পাবেন শুধু রপ্তানিকারকেরা। বিধিমালায় বলা হয়েছে, সাতটি শর্তে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশে বিনিয়োগ করার অনুমতি পাবে। এখন বিধিমালা তৈরির মধ্য দিয়ে দেশের ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগের সরাসরি সুযোগ তৈরি হলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১৩ সালে প্রথম একটি প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দেয় সরকার। এরপর বেশ কয়েকটি কোম্পানি বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে। আরও অনেক কোম্পানি বিদেশে বিনিয়োগের আবেদন করেছে। বর্তমানে দেশের ১৭টি ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি আছে।

নতুন বিধিমালা অনুসারে, বিনিয়োগে আগ্রহী যেকোনো প্রতিষ্ঠান তাদের আগের পাঁচ বছরের গড় রপ্তানি আয়ের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ অথবা তার সর্বশেষ নিরীক্ষিত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে প্রদর্শিত নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে সভাপতি করে ১৫ সদস্যের একটি কমিটি আবেদন যাচাই-বাছাই করবে। এরপর ওই কমিটি সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগের অনুমতি দেবে।

এই কমিটির সদস্য সচিব হবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগের মহা ব্যবস্থাপক।

ঋণখেলাপিরা সুযোগ পাবেন না

বিধিমালায় বলা হয়েছে, আগ্রহী বিনিয়োগকারীকে প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক বরাবর আবেদন করতে হবে। এরপর সেই আবেদন পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হবে বাছাই কমিটিতে। এ ক্ষেত্রে আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানটির বিদেশে বিনিয়োগের অর্থের পরিমাণ, বিনিয়োগের ক্ষেত্র, বৈদেশিক খাতের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট, বিনিয়োগ প্রস্তাবিত দেশের আইন ও ঝুঁকি এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়সংক্রান্ত জটিলতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেবে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ বিভাগ।

এরপর বাছাই কমিটি আবেদনকারীর বিদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাব পর্যালোচনা করে বিনিয়োগের সীমা হ্রাস-বৃদ্ধি কিংবা পুনর্বিনিয়োগের সুপারিশ করবে। এ ক্ষেত্রে বাছাই কমিটি প্রয়োজনে ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস, হাইকমিশন বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের মতামত নিতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

আবেদনের ক্ষেত্রে বিদেশে বিনিয়োগ প্রস্তাবকারী কোম্পানির শুল্ক, ভ্যাট ও আয়কর পরিশোধের সনদ এবং বিনিয়োগের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের সবার সম্মতি লাগবে। ঋণখেলাপি বা অসমন্বিত পুনর্গঠিত বড় ঋণ নেওয়া কোনো প্রতিষ্ঠান আবেদন করতে পারবে না।

আবেদনকারীকে বিনিয়োগকৃত দেশে নিবন্ধিত, প্রতিষ্ঠিত বা অধিগ্রহণ করতে যাওয়া প্রস্তাবিত কোম্পানির সম্পূর্ণ মালিকানা কিংবা পরিচালনা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম, এমন শেয়ারের মালিক হতে হবে। অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। বিনিয়োগের অর্থ বিনিয়োগকারী দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যাংকের মাধ্যমে উক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে পাঠাতে হবে।

এ ছাড়া কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে ওই দেশের আইন মেনে সর্বোচ্চসংখ্যক বাংলাদেশিকে সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং সরকারের যেকোনো প্রতিনিধি বিদেশে বিনিয়োগের কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শন করতে পারবে।

আবেদনকারী প্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক ব্যবসা পরিচালনা, অর্থায়ন ও বিনিয়োগে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল থাকতে হবে।

কোথায় বিনিয়োগ করা যাবে

আবেদন কোথায় করা যাবে, সে বিষয়েও বলা হয়েছে নতুন বিধিমালায়। এতে বলা হয়েছে, যেসব দেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের কাজ করার এবং অর্জিত অর্থ দেশে ফেরত আনার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই, সেসব দেশে বিনিয়োগের আবেদনকে অগ্রাধিকার দেবে বাছাই কমিটি। পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বৈত কর পরিহার, দ্বিপক্ষীয় পুঁজি বিনিয়োগ, উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও সংরক্ষণ চুক্তি রয়েছে, এমন দেশেও বিনিয়োগকে প্রাধান্য দেওয়া হবে।

অন্যদিকে যেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই এবং যাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অফিস অব ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোলের নিষেধাজ্ঞা আছে, সেখানে বিনিয়োগের অনুমতি দেবে না বাছাই কমিটি। পাশাপাশি, ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) যেসব দেশের বিরুদ্ধে প্রতিব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে, সেসব দেশেও বিনিয়োগের অনুমতি মিলবে না।

অনুমতি পাওয়ার পর কোনো কারণে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ করা সম্ভব না হলে প্রদত্ত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে বলা হয়েছে বিধিমালায়। এ ছাড়া বিনিয়োগ থেকে আসা আয় বা শেয়ার বিক্রি করা অর্থ বাছাই কমিটির সুপারিশ ছাড়া পুনর্বিনিয়োগ না করার বিধান করা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশি কোম্পানির মালিকানায় থাকা শেয়ার হস্তান্তর বা বিক্রির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে যেকোনো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চাইলেও অনুমতি নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের। আর বিনিয়োগের আয় ও লভ্যাংশ দেশে আনতে ব্যর্থ হলে তা অর্থ পাচার ও মানি লন্ডারিং হিসেবে বিবেচিত হবে।

প্রতি অর্থবছর শেষের ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিবরণী বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে পাঠাতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো বিরোধ সৃষ্টি হলে তা দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে নিষ্পত্তি করতে হবে।