খরচ কমানো নাকি বিনিয়োগ বাড়ানো, কোনটা করবে জার্মানির নতুন সরকার

১৬ বছরের শাসনামলে ম্যার্কেলের অর্থনৈতিক সফলতা কম নয়।
রয়টার্স

নির্বাচনের আগে জার্মানির বার্লিন শহরের মানুষ সবার জন্য স্বল্প ব্যয়ে আবাসনের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। তাঁদের অভিযোগ, সরকারি নীতির কারণে দেশে গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে বার্লিন শহরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৪০ শতাংশ। তবে এ সমস্যা শুধু বার্লিনেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই সব রাজনৈতিক দল নিজেদের মতো করে এ গৃহায়ণ সমস্যার সমাধানে নির্বাচনী ইশতেহারে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে সমস্যা শুধু গৃহায়ণ নয়, আঙ্গেলা ম্যার্কেলের উত্তরসূরিকে আরও অনেক আর্থসামাজিক সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। সে জন্যই আজ অনুষ্ঠিত জার্মান নির্বাচনের ফল নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের আগ্রহের শেষ নেই।

গত ১৬ বছর জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল। এ সময়ে বড় বড় সংকট মোকাবিলা করেছেন তিনি—আর্থিক সংকট, ইউরো অঞ্চলর ঋণসংকট, সিরিয়া যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অভিবাসী সংকট আর এখন তো দুই বছর ধরে মহামারি চলছেই। এর যেকোনো এক সংকটেই যেকোনো সরকারের পতন হতে পারে। সেই অর্থে বলা যায়, ম্যার্কেল বেশ ভালোভাবেই সব সামলেছেন। তাঁর শাসনামলে জার্মানিতে কর্মসংস্থান বেড়েছে এবং অর্থনীতির সম্প্রসারণ হয়েছে ৩৪ শতাংশ, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ।

কিন্তু আঙ্গেলা ম্যার্কেলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, এই সফলতা এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে ভিশন জাতির সামনে তাঁর তুলে ধরা উচিত ছিল, সেটি তিনি করেননি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ সময়ে জার্মান সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। এ ছাড়া চীনে পণ্য রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে তারা। সর্বোপরি ডিজিটালাইজেশন, বিকাশমান প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করার অভিযোগ আছে ম্যার্কেলের বিরুদ্ধে।

ভারী শিল্পে জার্মানি অনেকটাই এগিয়ে। সে কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে জার্মানিই সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৪৫ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে প্রযুক্তিগত যে উন্নয়ন ঘটাতে হবে, সে জন্য জার্মানিকে অন্তত ৫৪ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে।
এখানেই মূল চ্যালেঞ্জ। এ পরিমাণ বিনিয়োগ করতে সরকারের আয় বাড়াতে হবে বা ঋণ করতে হবে। অথচ গত দেড় বছরে মহামারি মোকাবিলায় জার্মান সরকার দুই হাত খুলে ঋণ নিয়েছে। এখন নির্বাচনের আগে রক্ষণশীল ও সামাজিক গণতন্ত্রী—উভয় দলই অঙ্গীকার করেছে, আবারও ঋণের লাগাম টেনে ধরা হবে। ফলে আজ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যাঁরা জিতবেন, তাঁদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে, ঋণের লাগাম টেনে ধরা এবং একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ নিশ্চিত করা।

উল্লেখ্য, ২০২০ ও ২০২১ সালে এ পর্যন্ত জার্মান সরকার ৩৭ হাজার কোটি ইউরো ঋণ করেছে। ২০২৩ সালের মধ্যে দেশটি এ ধারা থেকে বেরিয়ে আসবে বলে নেতারা অঙ্গীকার করেছেন।
জার্মান অর্থনীতিবিদ কার্স্টেন ব্র্যাজেস্কি টুইট করেছেন, একদিকে কাঠামোগত পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা করা হচ্ছে। এর জন্য বিপুল বিনিয়োগ দরকার। আবার অন্যদিকে বাজেটের রাশ টেনে ধরা বা ঋণে লাগাম পরানোর কথা বলা হচ্ছে। ফলে ব্যাপারটি অনেকাংশে বর চাওয়ার মতো হয়ে যাচ্ছে। নেতারা জনগণের প্রতি সৎ থাকলে তাঁদের উচিত হবে, এই পরিবর্তনের আর্থিক ব্যয়ভার সম্পর্কে কথা বলা। এ ছাড়া কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি যথাযথ কি না, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া।

এ পরিস্থিতিতে বিশ্লেষকেরা বলছেন, জার্মানির নতুন সরকার বাজেট সংকোচনের চেয়ে প্রযুক্তি ও জলবায়ুগত উন্নতিতে অধিকতর গুরুত্ব না দিলে অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে জার্মানির অবস্থান ক্ষুণ্ন হতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক-চতুর্থাংশ জিডিপির জোগান দিচ্ছে জার্মানি। সে কারণেই আজকের নির্বাচন জার্মানির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই মানছেন বিশ্লেষকেরা।

জনমত জরিপে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি এগিয়ে আছে। তারা অবশ্য ম্যার্কেলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পক্ষপাতী। তাদের যে জনপ্রিয়তা, তাতে বিশ্লেষকদের ধারণা, অর্থনীতিবিদেরা যে নাটকীয় সংস্কারের কথা বলছেন, জনগণ হয়তো ঠিক তার জন্য প্রস্তুত নয়।