২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

কোন দেশে কত মূল্যস্ফীতি

করোনা মহামারির কারণে গত এক বছরেরও বেশি সময়ে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের আয়রোজগার কমে গেছে। এখন করোনার সংক্রমণ কিছুটা কম হওয়ায় ও দেশে দেশে টিকা নেওয়ার হার বাড়ায় জীবনযাত্রায় কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরেছে। তবে নতুন এই চাহিদা সঙ্গে সরবরাহ তাল মেলাতে পারছে না। ফলে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে চলেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচ, শক্তিশালী চাহিদা ও সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নের সংমিশ্রণ অর্থনীতিবিদদের সামনের বছরের অর্থনীতি নিয়ে নতুন করে ভাবাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ইউরোজোনে ভোগ্যপণ্যের দাম গত অক্টোবরে তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বেড়েছে। তুরস্ক, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মতো উদীয়মান বাজারে মুদ্রাস্ফীতির হার দুই অঙ্কের ঘরে গিয়ে ঠেকেছে। এ পরিস্থিতিতে কেবল এশিয়া-প্যাসিফিকের কিছু অংশে যেমন—চীন, জাপান ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি এখনো তুলনামূলকভাবে কম। তবে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এ অঞ্চলে মূল্যস্ফীতি বাড়ার প্রবণতা রয়েছে।

রেটিং এজেন্সি এসঅ্যান্ডপির অর্থনীতিবিদ সিলভিয়ান ব্রয়ার বলেন, সাধারণভাবে বলতে গেলে মূল্যস্ফীতি সেই দেশগুলোতে বেশি বাড়ছে, যেখানে এটি গত বছর সবচেয়ে বেশি কমেছিল, যেমন জার্মানি। এ ছাড়া উদীয়মান অর্থনীতিতে বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব অর্থনীতিতে মুদ্রার অবমূল্যায়নের চেয়ে স্থানীয় পণ্যের মূল্য বাড়ছে বেশি দ্রুতগতিতে।

২০২১ সালে অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, হাঙ্গেরি, মেক্সিকো, পোল্যান্ড, তুরস্ক, ব্রাজিল, রাশিয়ায় মূল্যস্ফীতির হার ছাড়িয়েছে ৬ শতাংশের ওপরে। কারও কারও ছাড়িয়েছে দুই অঙ্ক। ট্রেডিং ইকোনমিকসের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ২ শতাংশে, মেক্সিকো ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ, রাশিয়া ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ, ব্রাজিল ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, তুরস্ক ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও আর্জেন্টিনা ৫২ দশমিক ২ শতাংশ।

মুদ্রাস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতি অনেক অর্থনীতিবিদকে বিস্মিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোজোন, ব্রাজিল ও পেরুতে এই বছরের জন্য মুদ্রাস্ফীতির পূর্বাভাস মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে দ্বিগুণ হয়েছে। এইচএসবিসির গ্লোবাল অর্থনীতিবিদ জেমস পোমেরয় বলেন, অর্থনীতিবিদেরা কয়েকটি বিষয়ে পূর্বাভাস ঠিক রাখতে পারেননি। শক্তির দাম, আসলে যার পূর্বাভাস দেওয়া খুব কঠিন। এ ছাড়া অর্থনীতিগুলো আবার চালু হওয়ার পরে যে পণ্যের চাহিদার সৃষ্টি হয়েছে তার স্থায়িত্ব কত দিন থাকবে। বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদেরা এখনো আশা করেন যে মূল্যস্ফীতি বর্তমান স্তর থেকে পরের বছর হ্রাস পাবে কারণ, এক দফা মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব কিছুটা কমে আসবে। তবে তাঁরা এ–ও আশঙ্কা করছেন যে মুদ্রাস্ফীতি যত দিন দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে ভাবা হচ্ছিল, তার চেয়েও বেশি সময় থাকবে। সেই সঙ্গে ২০২২–এর জন্য তাঁদের পূর্বাভাস সংশোধন করছেন। বার্কলেসের অর্থনীতিবিদ ক্রিশ্চিয়ান কেলার বলেছেন, সব অঞ্চলজুড়ে মুদ্রাস্ফীতির পূর্বাভাস পরিবর্তন প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।

তবে এখন এ রকম মূল্যবৃদ্ধি পেলেও তা ১৯৭০ বা ১৯৮০ এর দশকের কাছাকাছিও যায়নি। ওই সময় ওইসিডিভুক্ত ৩৮টি সদস্য দেশে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ১৫ শতাংশের ওপরে ছিল। তবে এখনো যে স্তরে আছে, তা ভোক্তাদের ওপর মারাত্মক প্রভাবই ফেলবে এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে ধীর করে দিতে পারে।

মুডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এলেনা ডুগার বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি গৃহস্থালির বাজেটকে চাপে ফেলবে এবং প্রবৃদ্ধির ওপর প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি বাধ্যতামূলকভাবে মজুরি বৃদ্ধির চাপ ফেলতে পারে। তবে এখানে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। এখানে দুর্বল অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং স্থিতিশীল মুদ্রার জন্য সামগ্রিকভাবে পণ্যের দাম ২ শতাংশেরও কম বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের বিশ্ব অর্থনীতিবিদ বেন মে বলেছেন, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মুদ্রাস্ফীতি তেমন বেশি নয়। চীনে দেখা গেছে উৎপাদন পর্যায়ে খরচ বাড়লেও ভোক্তার কাছে গিয়ে দাম বাড়েনি। অবশ্য এ অঞ্চলে এমন দেশও আছে যেখানে প্রতিদিন দ্রব্যমূল্য বাড়ছে।

দাম বাড়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো জ্বালানির ব্যয় বৃদ্ধি। ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে জ্বালানির দাম সেপ্টেম্বরে ২০ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৮ সালের পর যা সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি। সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও আগের বছরের তুলনায় ১ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ৪ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। খাদ্য ও জ্বালানি মূল্যস্ফীতি বাদ দিলেও ওইসিডিভুক্ত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে ৩ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ বিদ্যুতের দাম অর্থনীতিতে অন্য কাঁচামালের খরচ বাড়াচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হলো বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতি সাময়িক নাকি আরও স্থায়ী হবে। অর্থনীতিবিদেরা মনে করছেন এটি মূলত নির্ভর করছে মূল্যবৃদ্ধির ফলে অস্থিতিশীল মজুরি বৃদ্ধি হয় কি না তার ওপর। তবে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন যা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

সূত্র: ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস