করোনায় লেপ্টে গেছে ‘লিপস্টিক ইফেক্ট’
মন্দায় মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানো দায়, আর মানুষ বুঝি কিনবে লিপস্টিক? তাহলে কি অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম খাটে না লিপস্টিকের ক্ষেত্রে? নড়েচড়ে বসলেন অর্থনীতিবিদেরা। তৈরি হলো নতুন ধারণা ‘লিপস্টিক ইফেক্ট’।
গল্পটা ৯/১১ বা টুইন টাওয়ার হামলার পরের কথা। আমেরিকায় চলছে মন্দা, কমে গেছে সব পণ্যের বিক্রি। এর মধ্যে বিখ্যাত প্রসাধন কোম্পানি এস্টি লাউডারের চেয়ারম্যান লিওনার্দ লাউডার ঘোষণা দিলেন, এই মন্দা কিচ্ছুটি করতে পারেনি তাঁর লিপস্টিক ব্যবসায়। বরং মন্দায় তাঁর দামি লিপস্টিক বিক্রি আরও বেড়েছে।
এখন ঘটনা হচ্ছে, এস্টি লাউডার কোনো যেনতেন ব্র্যান্ড নয়। তাদের একেকটি লিপস্টিকের দামই পেল্লাই। সবচেয়ে যেটার কম দাম, সেটার দামও ২০০১ সালে ছিল ১২ ডলার। সাধারণ লিপস্টিক পাওয়া যায় দুই ডলারেই। মন্দায় মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটানো দায়, আর মানুষ বুঝি কিনবে লিপস্টিক? তাহলে কি অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম খাটে না লিপস্টিকের ক্ষেত্রে? নড়েচড়ে বসলেন অর্থনীতিবিদেরা। তৈরি হলো নতুন ধারণা ‘লিপস্টিক ইফেক্ট’।
অর্থনীতিবিদেরা দেখলেন, যেহেতু মন্দায় মানুষের হাতে টাকা নেই, মানুষ ভোগবিলাস একদম করতে পারছে না। কিন্তু তাই বলে কি মানুষের শখ-আহ্লাদ একদম শেষ হয়ে যাবে? তা–ও কি হয়? তো মানুষ তখন এমন সব বিলাসপণ্যে ব্যয় করে, যেগুলো তাঁদের মনকে প্রফুল্ল করে। সেগুলোও বিলাসপণ্য, তবে একটু কমদামি। তাই একটা সাধারণ লিপস্টিক না কিনে একটা দামি লিপস্টিক, দূরে কোথাও বেড়াতে না গিয়ে সিনেমা দেখে আর রোজ রোজ ভালো খাবার না কিনতে পারলেও মাসে একবার একটু ভালো রেস্তোরাঁয় খান। এভাবে মানুষ একটা ‘ভালো থাকার’ অনুভূতি পেতে চান। এত দিন এমনটাই চলে আসছিল। করোনা বদলে দেয় হিসাবটা।
সামনের ক্রিসমাসেও বিক্রি কমেরই পূর্বাভাস দিচ্ছে বাজার। ওদিকে একটা বড় অংশ প্রসাধনী বিক্রি হয় এয়ারপোর্টের শুল্কমুক্ত দোকানগুলোতে। মানুষ এখন ভ্রমণ না করায় বিক্রিও কমে গেছে। একই অবস্থা চলচ্চিত্রশিল্পেরও। গ্লোবাল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু মে মাসের শেষ পর্যন্ত আমেরিকার চলচ্চিত্রশিল্পের ক্ষতি হয়েছে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
যে এস্টি লাউডার বলেছিল, মন্দায় বাড়ে তাদের লিপস্টিকের বিক্রি, তারাই করোনার মন্দায় মত পাল্টেছে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদের প্রসাধনসামগ্রী বিক্রি কমেছে ৬১ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা লিপস্টিকের। একই অবস্থা অন্যান্য বড় ব্র্যান্ডের। কর্মী ছাঁটাই, আউটলেট বন্ধ করেও ঠেকাতে পারছে না ক্ষতি।
সামনের ক্রিসমাসেও বিক্রি কমেরই পূর্বাভাস দিচ্ছে বাজার। ওদিকে একটা বড় অংশ প্রসাধনী বিক্রি হয় এয়ারপোর্টের শুল্কমুক্ত দোকানগুলোতে। মানুষ এখন ভ্রমণ না করায় বিক্রিও কমে গেছে। একই অবস্থা চলচ্চিত্রশিল্পেরও। গ্লোবাল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শুধু মে মাসের শেষ পর্যন্ত আমেরিকার চলচ্চিত্রশিল্পের ক্ষতি হয়েছে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যতম ভারতের বলিউডও বিশ্বের একটি বড় চলচ্চিত্রশিল্প।
টাইমস অব ইন্ডিয়া সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শিল্পী, কলাকুশলী, নির্মাতা, পরিবেশক ও প্রেক্ষাগৃহ মিলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ক্ষতি পাঁচ হাজার কোটি মার্কিন ডলার এবং প্রতিদিনই তা বাড়ছে। অবস্থার বেগতিক দেখে অনেক পরিচালকই ২০২০ সালে চলচ্চিত্র প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ও লালবাতি জ্বলেছে করোনায়। ব্যবসা চালু রাখতে যদিও সব দেশই কমবেশি খুলে দিয়েছে রেস্তোরাঁ ও বেকারি। তারপরও মানুষের সমাগম আগের অবস্থায় ফিরছে না। ব্যবসায়ী উপাত্তবিষয়ক বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম স্ট্যাটিস্টা বলছে, করোনায় অক্টোবরের শুরু পর্যন্ত বসে খাওয়া হয় এমন রেস্তোরাঁগুলোর ৪০ শতাংশ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। চাকরি গেছে রাঁধুনি থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী সবার।
তো ৯/১১-এর পর মন্দায়ই ভালো চলা পণ্য এবং সেবার যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল, তা পুরোপুরি ওলটপালট হয়ে গেছে। আগের হিসাব দেখে কেউ নতুন করে এগোনোর সাহস দেখাচ্ছেন না। আবার নতুন ঠিক কোন পণ্যগুলো মন্দায় ভালো যাবে, তা–ও আন্দাজ করা যাচ্ছে না সহসাই।
কিন্তু মানুষের শরীরের মতো অর্থনীতিও করোনায় নিজেকে এদিক–সেদিক করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে লিপস্টিকের বাজার পড়তি হলেও ত্বকচর্চার অন্যান্য পণ্য যেমন ফেস মাস্ক, ময়েশ্চারাইজার ইত্যাদি ভালো চলছে। এমনকি লিওনার্দ লাউডারের মতো এসব বিক্রেতাদেরও দাবি, সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশিই যাচ্ছে। আবার সিনেমার বাজারে মন্দা এলেও জোয়ার এসেছে নেটফ্লিক্সের ব্যবসায়। এপ্রিল পর্যন্তই নেটফ্লিক্স ১ কোটি ৬০ লাখ নতুন সাবস্ক্রাইবার পেয়েছে। বেড়েছে ফুড ডেলিভারি ব্যবসার আকারও।
সামনে গেলে হয়তো এমন অনেক ছোট ছোট বিলাসপণ্যের খোঁজ পাওয়া যাবে, যেগুলো করোনায় সামনেই এগিয়েছে। ব্যবসায়ীরাও অপেক্ষায় আছেন করোনায় কোন পণ্যগুলো ‘লিপস্টিক ইফেক্ট’ দেখায়, তা জানতে। এই তালিকা ধরেই সামনে বিনিয়োগ করবেন তাঁরা।