তাইওয়ান কি যুক্তরাষ্ট্রের চিপশিল্প ছিনিয়ে নিয়েছিল

কম্পিউটার চিপ

বিতর্কিত মন্তব্য করার জন্য সুপরিচিত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও আগামী নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। এবার তাঁর কথা হলো—৫০০ বিলিয়ন বা ৫০ হাজার কোটি ডলার বাজারের চিপ ব্যবসায় একসময় যুক্তরাষ্ট্রের যে আধিপত্য ছিল, তাইওয়ান তা ছিনিয়ে নিয়েছে।

ব্লুমবার্গ বিজনেসউইকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় পুরো সেমিকন্ডাক্টর শিল্প তাইওয়ান ছিনিয়ে নিয়ে গেছে; সেটা মোটেও হতে দেওয়া উচিত হয়নি।

ট্রাম্প আরও বলেন, ‘তাইওয়ানের উচিত, যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিরক্ষা বাবদ অর্থ দেওয়া। আমরা বিমা কোম্পানির চেয়ে ভিন্ন কিছু নই; কিন্তু তাইওয়ান আমাদের কিছু দেয় না।’ দূরত্বের কারণে তাইওয়ানকে রক্ষা করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কঠিন হবে উল্লেখ করেন তিনি। ট্রাম্প বলেন, তাইওয়ান যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৯ হাজার ৫০০ মাইল দূরে, কিন্তু চীন থেকে মাত্র ৬৮ মাইল দূরে।

সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের কথায় বিতর্ক হবে না, এমনটা সম্ভবত স্মরণকালে হয়নি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের এই দাবি ঠিক নয়। তাইওয়ান কঠোর পরিশ্রম, দূরদৃষ্টি ও বিনিয়োগের মতো বিষয়গুলোর স্বাভাবিক সম্মিলনের মধ্য দিয়ে এই শিল্পের বিকাশ ঘটিয়েছে।

দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানের বিদ্যালয়পড়ুয়া ছোট ছোট শিশুরাও জানে, ৯৩ বছর বয়সী চীনা বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক মরিস চ্যাং তাইওয়ানের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৮৭ সালে ৫৫ বছর বয়সে তিনি তাইওয়ানে এই শিল্পের গোড়াপত্তন করেন, এরপর কেবল ইতিহাস রচনার পালা।

সেই সময় বিশ্বের সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের নেতৃত্বে ছিল ইনটেল, মটোরোলা ও টেক্সাস ইনস্ট্রুমেন্টস—এসব প্রতিষ্ঠানে মরিস চ্যাং একসময় কাজ করেছেন। কিন্তু নিজের সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি টিএসএমসি চালু করার সময় চ্যাং ভিন্ন চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করেন, সেই চিন্তা তখন একেবারেই ছিল বিপ্লবী।

মরিস চ্যাং ২০০৭ সালে এক মৌখিক ইতিহাস প্রকল্পে অংশ নিয়ে বলেন, ‘আমাদের তখন গবেষণা ও উন্নয়নে শক্তি ছিল না, বা যা ছিল তা–ও যৎসামান্য। সার্কিট ডিজাইনের কোনো শক্তিই ছিল না। পণ্য বিক্রয় ও বিপণনে আমাদের শক্তি ছিল খুবই সামান্য, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ কিছু ছিল না বললেই চলে। তখন তাইওয়ানের সম্ভাব্য শক্তি ছিল একটি। সেটিও তখন দৃশ্যমান কিছু ছিল না, তা হলো সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন।’

সেখান থেকেই ক্রেতাদের ডিজাইন অনুসারে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনের ধারণার সূত্রপাত। এরপর অবশ্য কোম্পানির অভ্যন্তরীণ ডিজাইন ও উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি হলে নতুন মডেলের সূত্রপাত হয়।

সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনে ভাষ্য, নতুন এই মনোভঙ্গি বৈশ্বিক ইলেকট্রনিকস খাতের গতিপ্রকৃতি বদলে দেয় এবং এই শিল্পে তাইওয়ানকে নেতৃত্বের আসনে বসানোর পথ তৈরি করে। সেই পথ ধরে তাইওয়ান এখন বিশ্বের ৯০ শতাংশ উন্নত চিপ তৈরি করছে।

একসময় অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিল জীবাশ্ম জ্বালানি, এখন সেই জায়গা নিয়েছে প্রযুক্তি। ‘চিপ ওয়ার: দ্য ফাইট অর দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি’ গ্রন্থের লেখক ক্রিস্টোফার মিলার বলেছেন, টিএসএমসি সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে জোর দিতে পেরেছে এবং তারা একসঙ্গে একাধিক কোম্পানির জন্য কাজ করতে পেরেছে। এর ফলে তাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

ক্রিস্টোফার মিলার আরও বলেন, এই যে একসঙ্গে অনেক কোম্পানির জন্য কাজ করতে পারা; এটাই টিএসএমসির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারা বিপুল পরিমাণে আয় করতে পেরেছে এবং এরপর সেই অর্থ চিপ উৎপাদন প্রযুক্তির উন্নয়নে ব্যয় করেছে। পরিণামে উৎপাদন ব্যয় কমেছে; পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়া আরও দক্ষ হয়েছে।

এই প্রক্রিয়ায় বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত চিপ উৎপাদন প্রযুক্তি টিএসএমসির হাতে। প্রযুক্তি উন্নয়নে তারা আরও বিনিয়োগ করতে চায়। গত বছরের জুলাই মাসে টিএসএমসি নিজেদের প্রধান কার্যালয়েও গবেষণা ও উন্নয়নকেন্দ্র চালু করেছে।

কিন্তু পরিস্থিতি এখন ভিন্ন মোড় নিচ্ছে। তাইওয়ানের প্রধানমন্ত্রী চো জাং-তাইকে সিএনএন জিজ্ঞাসা করেছিল, এখন যুক্তরাষ্ট্র কিছু কিছু গবেষণা ও উন্নয়নকেন্দ্র নিজ দেশে সরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিলে কী করবেন। জবাবে চো বলেন, যেভাবে চলেছে এত দিন, সেভাবেই চলবে; কাজের ধরনে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা নেই।

চো জাং-তাই আরও বলেন, তাইওয়ানে মেধার সংকট নেই; সেই সঙ্গে আছে গবেষণা ও উন্নয়নের যথোপযুক্ত পরিবেশ। তিনি বিশ্বাস করেন, তাইওয়ানে এই চিপশিল্প টিকিয়ে রাখতে গবেষণা ও উন্নয়নকেন্দ্রগুলো নিজ দেশেই রাখতে হবে।