মূল ধারার বিনিয়োগ মাধ্যম হতে যাচ্ছে বিটকয়েন

বিটকয়েনছবি: রয়টার্স

ডিজিটাল মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সির বিষয়ে মানুষের মনোভাবে পরিবর্তন আসছে। আগে যাঁরা এই মুদ্রা কিনতে চাইতেন না, এখন তাঁরা এটির বাড়বাড়ন্ত দেখে ঈর্ষা বোধ করছেন।

লন্ডন শহরে বসবাসরত মাইলস নামের এক চিকিৎসক অনেক দিন ধরে বন্ধুদের ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করছেন। কিন্তু বন্ধুরা কিছুতেই তাঁর কথা কানে তোলেননি। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিশেষ করে বিটকয়েনের দাম হু হু করে বাড়ছে। ফলে মাইলসের বিনিয়োগ ফুলে–ফেঁপে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩ মিলিয়ন বা ২৩ লাখ পাউন্ড। ক্রিপ্টোকারেন্সি আয় থেকে চলতি বছরের শুরুতে বাড়ি কেনার জন্য মাইলস ৬ লাখ পাউন্ড তুলে নিয়েছেন। খবর দ্য গার্ডিয়ানের

মাইলস সেই ২০১২ সালে বিটকয়েনে ৪ হাজার পাউন্ড বিনিয়োগ করেছিলেন। বিটকয়েনের মূল্য প্রতিদিনই ওঠানামা করলেও তিনি এখন অর্থনৈতিকভাবে নিজেকে নিরাপদ বোধ করেন।

ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার আগেই বিটকয়েনের দাম ৯৭ হাজার ডলারে উঠেছে, সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তখন তিনি অঙ্গীকার করেন, বিটকয়েনকে মূল ধারার সম্পদ হিসেবে অনুমোদন দেবেন। ফলে গত এক মাসে বিটকয়েনসহ ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ বেড়েছে। যুক্তরাজ্যের ফাইন্যান্সিয়াল কনডাক্ট অথরিটির (এফসিএ) ভাষ্য, যুক্তরাজ্যের ১২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাতে ক্রিপ্টোকারেন্সি আছে।

এফসিএর জরিপে দেখা গেছে, বেশির ভাগ বিনিয়োগকারী গত চার বছরে এই ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজারে বিনিয়োগ করেছেন। এ ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে কোভিড লকডাউন। ওই সময় ব্রিটেনসহ উন্নত দেশগুলোতে সরকার প্রণোদনা দিয়েছে; মানুষ ঘর থেকে বেরোতে পারেনি। ওই সময়ে অ্যাপস ও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ সহজ করা হয়। ফলে মানুষ তখন অবসর সময়ে এই মুদ্রায় বিনিয়োগ করে।

এক জরিপে দেখা গেছে, এখন বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ, যেমন শিক্ষক, ব্যাংকার নার্স ও আইটি পেশাদারেরা এই ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করছেন। ফলে একসময় কারেন্সি যে শুধু প্রযুক্তি জগতের মানুষের বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে মনে করা হতো, সেই ধরাবাঁধা চিত্রটা পাল্টে গেছে। এই শ্রেণির মানুষেরা মনে করছেন, বড় ধরনের ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিয়োগের সেরা মাধ্যম। মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই বলেছেন, প্রথাগত আর্থিক ব্যবস্থায় তাঁদের আস্থা কমে গেছে। সে কারণে তাঁরা নিজেদের জীবনের লক্ষ্য পূরণের জন্য এই মুদ্রা কেনার দিকে ছুটছেন।

মোদ্দা কথা হলো, মানুষ এখন আর্থিক অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে সুরক্ষা হিসেবে বিটকয়েনসহ বিভিন্ন ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করছেন। ইংল্যান্ডের নটিংহ্যাম শহরের ৫৭ বছর বয়সী জুলিয়ান তেমন একজন মানুষ। তিনি বলেছেন, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির হাত থেকে বাঁচতে তিনি বিটকয়েনে বিনিয়োগ করেছেন; একই সঙ্গে প্রথাগত বিভিন্ন সঞ্চয়ের মাধ্যমে সুদের হার কমে যাওয়া এবং সরকারের টাকা ছাপানোর প্রবণতার কারণে অর্থের ক্রয়ক্ষমতা দিন দিন কমছে।

তবে প্রথম দিকে জুলিয়ানের বিনিয়োগ একদম মসৃণ ছিল না। বিনিয়োগের পরপরই মূল্য ৫০ শতাংশ কমে যায় এবং একটানা বেশ কয়েক বছর বিটকয়েনের বাজার মন্দা গেছে। কিন্তু তিনি এর মধ্যেও তা বিক্রি করেননি। কারণ, বাজারের আচরণ সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন। টানা চার বছর বিটকয়েনের দাম কম ছিল; এই সময় তিনি ধারাবাহিকভাবে বিটকয়েন কিনেছেন। এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বিটকয়েনের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে।

জুলিয়ান বলেন, ‘বিটকয়েন বিক্রির পরিকল্পনা আমার নেই। আমি মনে করি, সন্তানদের জন্য উত্তরাধিকারের সম্পদ হিসেবে বিটকয়েন রেখে যাব। আমি নিশ্চিত, এর দাম বাড়তেই থাকবে। এখন মনে হচ্ছে, আমার কাছে কত-ই বা বিটকয়েন আছে, যা আছে তা যথেষ্ট নয়।’

এই শ্রেণির অনেক বিনিয়োগকারীর আশা, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে বিটকয়েনের দাম ১ লাখ ২০ হাজার ডলারে উঠতে পারে।

ওই জরিপে অংশ নেওয়া ডাবলিনের এক আইনজীবী বলেছেন, মার্কিন সরকার যদি ট্রেজারি রিজার্ভ হিসেবে বিটকয়েন সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে এই মুদ্রার দাম যে কোথায় যাবে, তা বলাই বাহুল্য। নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ওই আইনজীবী জানান, তিনি বিটকয়েনে ৪০ হাজার ইউরো বিনিয়োগ করেছিলেন, যা বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৬২ হাজার ইউরো।

একইভাবে নর্থ ইয়র্কশায়ারের ১৮ বছর বয়সী তরুণ সাইলাস গান জানান, তিন বছর আগে তিনি ৫ হাজার পাউন্ড বিনিয়োগ করেছিলেন, যার বর্তমান মূল্য ৯৫ হাজার পাউন্ড। সাইলাস আশাবাদী, তাঁর এই বিনিয়োগের মূল্য ৫ লাখ পাউন্ডে উঠে যাবে।

বিনিয়োগকারীরা আশা করছেন, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর আরও কিছু অনুকূল বিধিবিধান প্রণয়ন করা হবে। দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এত দিন মূলত ব্যক্তিপর্যায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ন্ত্রণ করত, এ ব্যাপারে সমন্বিত কোনো বিধিবিধান ছিল না। বিনিয়োগকারীদের আশা, এখন তা হবে।

বিটকয়েনের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি ছাড়াই এটি লেনদেন করা যায়। কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের নজরদারির বাইরে গিয়ে ভালো কাজ করা যাবে, এই ছিল বিটকয়েনের প্রতিষ্ঠাতা সাতোসি নাকামোতোর আশা।

এই যে পৃথিবীজুড়ে দুই পক্ষের মধ্যে সরাসরি লেনদেনের একটি ব্যবস্থা তৈরি হলো, তার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক ফল হলো কালোবাজারি। লেনদেন যেহেতু দুই পক্ষের মধ্যেই হয়, তাই তা ধরাও মুশকিল। ধরা যাক, আপনি প্রচলিত মুদ্রার বিনিময়ে কারও কাছ থেকে বিটকয়েন কিনলেন। যার কাছ থেকে কিনলেন তাঁর লেজারে বিটকয়েন কমে গেল। তৈরি হলো আপনার লেজার, যে কয়টা বিটকয়েন কিনলেন সেগুলো সেখানে জমা হলো। যাঁরা বিটকয়েন কেনেন, তাঁদের বলা হয় ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনার। এটি বিক্রির সময় বিক্রেতার সিলমোহর লাগে। তবে কোনো সরকারি সংস্থার কোনো স্বীকৃতির দরকার হয় না। এ কারণে বিটকয়েনের মাধ্যমে অপরাধমূলক কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এটির ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এখন ট্রাম্প জমানায় যুক্তরাষ্ট্র বিটকয়েনের ‘কেন্দ্র’ হলে অনেক দেশেই তা আইনি বৈধতা পাবে।