রেস্তোরাঁয় পরিচারকের কাজ করা জেনসেন হুয়াং এখন বিশ্বের ১৩তম ধনী
কদিন আগেই চিপ কোম্পানি এনভিডিয়া বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানির তকমা পেয়েছে। এখন তারা দ্বিতীয় স্থানে নেমে গেছে। কোম্পানিটির এই উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী জেনসেন হুয়াংয়েরও সম্পদমূল্য বেড়েছে। বদৌলতে তিনি বৈশ্বিক বিলিয়নিয়ার বা শতকোটিপতি তালিকায় ১৩তম স্থানে উঠে এসেছেন।
তবে জেনসেন হুয়াংয়ের জীবনের পথপরিক্রমা অতটা মসৃণ ছিল না। বিশ্বের এই অতি ধনী একসময় রেস্তোরাঁয় ওয়েটার বা পরিচারক হিসেবে কাজ করতেন। এখন তিনি তিন ট্রিলিয়ন বা তিন লাখ কোটি ডলারের কোম্পানির মালিক। ছোটবেলায় থাইল্যান্ড থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। খবর ফোর্বস ম্যাগাজিন ও সিএনবিসির।
গতকাল শনিবার অবশ্য জেনসেন হুয়াংয়ের সম্পদমূল্য কমেছে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা ৩৬০ কোটি ডলার। সেদিন দুপুরে তাঁর সম্পদমূল্য দাঁড়ায় ১১০ দশমিক ৮ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ৮০ কোটি মার্কিন ডলার। আগের দিন শুক্রবার তিনি ছিলেন বিশ্বের ১১তম শীর্ষ ধনী।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রসেসর দরকার, বৈশ্বিক বাজারে সেটির মূল উৎস এখন এনভিডিয়া। ফলে চলতি বছর এনভিডিয়ার শেয়ারের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছর এই কোম্পানির শেয়ারের দাম তিন গুণ বেড়েছে। অথচ চলতি বছর মাইক্রোসফটের মতো কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে মাত্র ১০ শতাংশ। শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে গত মঙ্গলবার বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানির তকমা অর্জন করে এনভিডিয়া। সেই সঙ্গে কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জেনসেন হুয়াংয়ের সম্পদমূল্যও বেড়েছে।
এনভিডিয়ার প্রধান কার্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সান্তা ক্লারায়। এটি সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার প্রস্তুতকারী কোম্পানি। গ্রাফিক প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ), অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস (এপিআই), মোবাইল কম্পিউটিং ও সিস্টেম অন চিপ ইউনিট (এসওসি) তৈরি করে তারা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের একচেটিয়া ব্যবসা করছে তারা।
জেনসেন হুয়াং ১৯৬৩ সালে তাইওয়ানের তাইনানে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে পাঁচ বছর বয়সে তাঁর পরিবার থাইল্যান্ডে চলে যায় এবং ৯ বছর বয়সে তাঁকে ও তাঁর ভাইকে ওয়াশিংটনের টাকোমায় এক চাচার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পরপর কেন্টাকির এক বোর্ডিং স্কুলে ভতির করা হয় জেনসেনকে। সেই স্কুলটি ছিল এক ধরনের সংশোধনমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে সমস্যাগ্রস্ত কিশোরদের পাঠানো হতো। কিন্তু জেনসেংয়ের চাচা-চাচি তা জানতেন না।
সেই বোর্ডিং স্কুলে ক্লাসের পর প্রতিদিন জেনসেনকে ছেলেদের বাথরুম পরিষ্কার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার ভাই তখন কাজ করত এক তামাক কারখানায়। একপর্যায়ে তিনি রেস্তোরাঁয় পরিচারক হিসেবে কাজ নেন। তাঁর ভাষ্য, এ কাজ তাঁর লজ্জা ও জড়তা কাটাতে সহায়তা করেছে।
ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন জেনসেন হুয়াং। ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ইলেকট্রিক প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। এরপর স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন জেনসেন। পড়াশোনা শেষ করে জেনসেন এলএসআই লজিকের কোরওয়্যারের ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দেন। বছরখানেক চাকরি করার পর ১৯৯৩ সালে ক্রিস মালাচোস্কি ও কার্টিস প্রিমের সঙ্গে এনভিডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। এনভিডিয়ার সিইও ও প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন তিনি। সে সময় তাঁর বয়স ছিল ৩০। ২০০৭ সালে তাঁর বার্ষিক বেতন ছিল ২৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন বা ২ কোটি ৪৬ লাখ ডলার। ফলে ফোর্বস ম্যাগাজিনের তালিকায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৬১তম সর্বোচ্চ বেতনভোগী সিইও হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।
এনভিডিয়া বহুদিন গেমিং কনসোলের চিপ তৈরি করেছে। এই চিপ গেমের ভারী গ্রাফিকস নিয়ন্ত্রণে কাজ করত; কিন্তু কয়েক বছর আগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা গবেষকেরা গেমের জন্য বিশেষায়িত চিপগুলো দিয়ে শক্তিশালী সব অ্যালগরিদম পরিচালনা করা শুরু করেন। এতেই খেলা ঘুরে যায়।
এসব চিপ একই সঙ্গে অনেক ডেটা বিশ্লেষণ ও প্রক্রিয়াজাত করতে পারে। যেমন মেশিন লার্নিং, ভিডিও এডিটিং ও গেমিং অ্যাপ্লিকেশনগুলোর জন্য ডেটাকে উপযোগী করে তোলা। প্রযুক্তিজগতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নতুন সংস্করণ সৃষ্টির বদৌলতে ফুলেফেঁপে ওঠে এই কোম্পানি। গত বছরের মে মাসে এনভিডিয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক (এআই) আরও উন্নত ও উচ্চক্ষমতার নতুন চিপ নির্মাণের ঘোষণা দেয়। ফলে স্টক মার্কেটে কোম্পানিটির বাজার মূলধন এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি ডলারে উঠে যায়। সেখান থেকে এক বছরের মধ্যে তাদের বাজার মূলধন তিন ট্রিলিয়ন বা তিন লাখ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।
এনভিডিয়ার চলার পথ অত মসৃণ ছিল না। একাধিকবার ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়তে হয়েছে হুয়াংকে। শুরুর দিকে চিপ বানাতে তাঁরা হিমশিম খান। সঠিক ও কার্যকর চিপ বানাতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হন। কয়েক বছর পর অবশেষে সফলতার মুখ দেখেন।
১৯৯৬ সালে যখন এনভিডিয়ার বয়স মাত্র তিন বছর, তখন তাদের প্রধান অংশীদার ভিডিও গেমিং কোম্পানি সেগার সঙ্গে চুক্তি ভেঙে যায়। গেমিং কনসোলগুলোতে থ্রিডি গ্রাফিকসযুক্ত করতে চিপ তৈরির চুক্তি ছিল সেগার সঙ্গে এনভিডিয়ার। অর্থের হিসাবে নতুন একটি কোম্পানির জন্য অনেক বড় চুক্তি ছিল এটি। কিন্তু ভুল নকশা ও উইন্ডোজের সঙ্গে কাজ না করায় এনভিডিয়া বেকায়দায় পড়ে যায়।
হুয়াং সে সময় ভাবেন, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো সেগার সঙ্গে এ নিয়ে খোলামেলা কথা বলা।
হুয়াংয়ের ভাষ্যে, ‘টাকার কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম; কিন্তু সেগার সিইও আমাকে অবাক করে দিয়ে চুক্তি ভঙ্গের আগে যতটুকু কাজ হয়েছিল, ততটুকুর অর্থ পরিশোধ করেন। ফলে আরও ছয় মাস টিকে থাকার মতো অর্থের সংস্থান হয় আমাদের।’
সেই অর্থ চিপ আরআইভিএ ১২৮ তৈরিতে ব্যবহার করে এনভিডিয়া। এটি ডাইরেক্টএক্সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। নতুন চিপটি বাজারের অন্যান্য চিপের তুলনায় উচ্চতর গ্রাফিক রেজল্যুশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। ১৯৯৭ সালে চার মাসের মধ্যে এই চিপের ১০ লাখের বেশি ইউনিট বিক্রি হয়। এটিই তাদের ভাগ্য ঘুরিয়ে দেয়। পরের ঘটনাবলি এখন তো ইতিহাস।