মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে বিপাকে পড়েছে চীন, ব্যাহত হচ্ছে বাণিজ্য
চীনের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের ইনজিং অঞ্চলে মিয়ানমারের সঙ্গে যে সীমান্ত ছিল, তা একসময় মোটামুটি অরক্ষিতই ছিল। এই গ্রাম সম্পর্কে বলা হতো, দুই দেশের এক গ্রাম। সীমানাখুঁটি বলতে ছিল বাঁশের বেড়া। কিন্তু সেই চেনা দৃশ্য আর নেই।
এখন সেখানে আছে উঁচু ধাতব দেয়াল; সেই দেয়ালের ওপর আছে কাঁটাতারের বেড়া। নজরদারির জন্য আছে সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরা। এই উঁচু বেড়া ধানখেতকে দুভাগে বিভক্ত করেছে। দুই দেশের রাস্তাও ভাগ হয়ে গেছে। খবর বিবিসির
বিষয়টি হলো, চীনের ভূমিবেষ্টিত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করতে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বাণিজ্য রুট তৈরিতে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। নতুন বাণিজ্যপথের মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার ও বাণিজ্য সহজ করার লক্ষ্যে এই প্রকল্প হাতে নিয়েছিল তারা। কিন্তু ২০২১ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি বদলে যায়। এরপর শুরু হয় জান্তা সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর গৃহযুদ্ধ। এতে চীনের সেই পরিকল্পনা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের শাসক ও বিদ্রোহীদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে গিয়ে চীন পড়েছে উভয়সংকটে।
বেইজিংয়ের অর্থায়নে নির্মিত চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর প্রায় ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি, অবকাঠামো ও বিরল খনিজ সংগ্রহের জন্য এই বাণিজ্যপথ চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই বাণিজ্যপথের কেন্দ্র আছে রেলপথ-চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং থেকে মিয়ানমারের পশ্চিম উপকূলে কেয়াকফিউয়ে চীনের নির্মীয়মাণ গভীর সমুদ্রবন্দরকে যুক্ত করেছে এই রেলপথ।
বঙ্গোপসাগর তীরের এই বন্দরের কল্যাণে ভারত মহাসাগরের মধ্য দিয়ে বিশ্ববাজারে শিল্পপণ্য বাজারজাত করা যাবে। একই সঙ্গে এই বন্দর থেকে মিয়ানমার হয়ে ইউনানে জ্বালানি পরিবহন করা হবে। চীন বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেল আমদানিকারক। ফলে দেশটির জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে এই বন্দর সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
কিন্তু গত কয়েক বছরে এই পথ মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক জান্তা ও বিদ্রোহী বাহিনী উভয়ের ওপরই চীনের প্রভাব আছে। কিন্তু সম্প্রতি এদের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি ভেস্তে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে বেইজিং। এর জবাবে সীমান্তে সামরিক মহড়া বৃদ্ধি করেছে চীন। সেই সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের কাছে নিজেদের উদ্বেগ জানিয়েছে চীন।
মিয়ানমারে চীনা বিনিয়োগ সীমান্তবর্তী শহরগুলো অর্থনীতিতে প্রাণ দিয়েছিল। কিন্তু গৃহযুদ্ধের কারণে তা ধ্বংস হতে বসেছে। মিয়ানমারের মিউজ শহরের বাসিন্দারা তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এই শহরের দোকানি লি মিয়ানজেন বিবিসিকে বলেন, মিয়ানমারের মানুষেরা এখন পশুর মতো বসবাস করছে। তিনি একসময় সীমান্তের ওপারে চীনের রুইলি শহর থেকে পণ্য কিনে এনে বিক্রি করতেন; কিন্তু এখন আন্তসীমান্ত–বাণিজ্য কমে যাওয়ায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে।
মিয়ানমারের অনেক মানুষ চীনে ছোটখাটো চাকরি করেন। কেউ কেউ স্বল্প বেতনের কাজের জন্য ঝুঁকি নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তাঁদের চলাফেরা ব্যাহত হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, মিয়ানমারে কাজ খুব কম; জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ জোগাড় কঠিন। এর আগে মিউজ শহরের বাসিন্দারা চীনের কঠোর লকডাউনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। এখন আন্তসীমান্ত পরিবহন ও বাণিজ্য পুনরায় শুরু না হলে ব্যবসা-বাণিজ্যই বন্ধ হয়ে যাবে।
এ বাস্তবতায় সীমান্তে মিয়ানমারের মানুষের ভিড় বাড়ছে। তাঁরা সবাই চীনে কাজ করার অনুমতি চান। কিন্তু সবাই তো আর অনুমতি পাচ্ছেন না। যাঁরা পাচ্ছেন না, তাঁদের সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।