ডেটিং অ্যাপে আগ্রহে ভাটা, ব্যবসা কমছে কোম্পানির

বিশ্বে একসময় অনেকেই ডেটিং অ্যাপে ভালোবাসার মানুষ বা জীবনসঙ্গী খুঁজতেন। কিন্তু মিলেনিয়াল, জেন-জি, জেন-এক্স ও বেবি বুমার প্রজন্মের অধিকাংশেরই ডেটিং অ্যাপে আগ্রহ কমেছে।

একসময় সারা বিশ্বেই বিভিন্ন ডেটিং অ্যাপের বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এসব অ্যাপের মাধ্যমে নিজেদের ভালোবাসার মানুষ বা জীবনসঙ্গী খুঁজে পেতেন বা পেয়েছেন অনেকেই। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ডেটিং অ্যাপগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে অনীহা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে নারীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে অ্যাপগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্যেও প্রভাব পড়েছে। 

সম্প্রতি ফোর্বস হেলথের এক সমীক্ষায় জানা গেছে, প্রায় ৭৭ শতাংশ মানুষ ডেটিং অ্যাপ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে মিলেনিয়াল প্রজন্মের (জন্ম ১৯৮১-১৯৯৬) ৮০ শতাংশ, জেন-জি (১৯৯৭-২০১২) প্রজন্মের ৭৯ শতাংশ, জেন-এক্স (১৯৬৫-১৯৮০) প্রজন্মের ৭৮ শতাংশ আর বেবি বুমার( ১৯৫৫-১৯৬৪) প্রজন্মের ৭০ শতাংশ মানুষ ডেটিং অ্যাপ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। 

ডেটিং অ্যাপগুলোতে সব সময় নতুন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ও মিথ্যাচারের পরিমাণ এত বেশি হয় যে মানুষ এসব অ্যাপ ব্যবহার করতে করতে ক্লান্ত বোধ করছেন। এমনকি সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রে তাঁরা এখন সন্দেহবাতিকগ্রস্তও হয়ে পড়ছেন। 

পশ্চিমা অনলাইন ডেটিং জগতের অন্যতম বৃহৎ নাম বাম্বল। সম্প্রতি নারীদের এই ডেটিং অ্যাপ ব্যবহারে আগ্রহী করতে এক বিজ্ঞাপন চিত্র প্রচার করে সংস্থাটি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। বিজ্ঞাপন চিত্রে দেখানো হয়, এক নারী সন্ন্যাসী হওয়ার ব্রত করেছেন। কিন্তু শেষমেশ একজনের প্রেমে পড়ে যান। এরপর প্রতিক্রিয়া এমন পর্যায়ে চলে যায় যে বাম্বলকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে হয়। এই বিজ্ঞাপনের ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় বাম্বলের শেয়ারের দামও কমে যায়। বিষয়টি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। দেখা যাচ্ছে, পুরো ডেটিং অ্যাপ-শিল্পই এখন বড় ধরনের সংকটে পড়ে গেছে। 

আয় কমে যাওয়ার জেরে চলতি মাসে বাম্বলের শেয়ারের দাম কমেছে ৩০ শতাংশ। একই সঙ্গে অন্যান্য ডেটিং অ্যাপ, যেমন ম্যাচ গ্রুপ, ওকে কিউপিড, হিঞ্জ ও অন্যান্য অ্যাপের প্রিমিয়াম গ্রাহক কমে গেছে। টানা সাত প্রান্তিকে এই অ্যাপগুলোর প্রিমিয়াম গ্রাহক কমেছে। পিউ রিসার্চের এক জরিপে দেখা গেছে, সামগ্রিকভাবে অনলাইন অ্যাপগুলোতে যাঁরা ডেট করতেন, তাঁদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক এবং নারীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অভিযোগ করেছেন, এসব অ্যাপ ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নেতিবাচক। 

কয়েক বছর ধরেই অনলাইন ডেটিং অ্যাপগুলোর অবস্থা ভালো নয়। এই জগতের সবচেয়ে বড় দুটি কোম্পানি যথাক্রমে টিন্ডার ও বাম্বলের বাজার মূলধন ২০২১ সালের পর ৪০ বিলিয়ন বা ৪ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের বেশি কমেছে। আর্থিক ক্ষতি হওয়ার কারণে কোম্পানিগুলো কর্মী ছাঁটাই করছে। 

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোম্পানিগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। যাঁরা নতুন নতুন ফিচার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চান, মূলত তাঁরাই নতুন দায়িত্ব পাচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, তরুণেরা এখন আর অর্থ দিয়ে ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করতে চান না; অর্থাৎ তাঁরা প্রিমিয়াম গ্রাহক হতে চাচ্ছেন না। বিষয়টা এমন নয় যে তরুণেরা অনলাইনের জগৎ থেকে সরে গিয়ে বাস্তব জগতেই জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছেন; বরং অনলাইন অ্যাপের অভিজ্ঞতা ভালো না হওয়ায় তরুণেরা এখন স্ন্যাপ চ্যাট ও টিকটকের মতো সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মে গিয়ে জীবনসঙ্গী খোঁজার চেষ্টা করছেন। আবার এটাও ঠিক পরিষ্কার নয় যে কী করলে এই তরুণদের অনলাইন ডেটিং অ্যাপগুলোতে টেনে আনা যাবে। 

ম্যাচ গ্রুপ ও বাম্বলের মতো কোম্পানি রাজস্ব আয়ের বড় অংশই প্রিমিয়াম গ্রাহকদের (অর্থের বিনিময়ে ব্যবহারকারী) কাছ থেকে সংগ্রহ করে থাকে। ২০২৩ সালে এই দুই কোম্পানি গ্রাহকদের কাছ থেকে ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন না ৪২০ কোটি ডলার করে আয় করেছে। এর বিপরীতে বিজ্ঞাপন থেকে আয় হয়েছে খুব সামান্য। কিন্তু এখন তারা প্রিমিয়াম গ্রাহক পাচ্ছে না। ম্যাচ গ্রুপ গত বছর প্রিমিয়াম গ্রাহকদের মাশুল বৃদ্ধি করে রাজস্ব আয় স্থিতিশীল রেখেছে। 

এই বাস্তবতায় বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, তরুণদের এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। ওয়াল স্ট্রিটের বিনিয়োগকারীরা এখন বিজ্ঞাপনের চেয়ে গ্রাহকদের মাশুলের ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। কারণ, এখান থেকে সহজে রাজস্ব আয় করা সম্ভব; বিজ্ঞাপনের বিষয়টা যেখানে কিছুটা অনিশ্চিত। 

যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এবং অনূর্ধ্ব ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে অর্ধেক মানুষ এই ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করেন বলে পিউ রিসার্চের এক জরিপে জানা গেছে। ব্যবহারকারীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ প্রিমিয়াম গ্রাহক; অর্থাৎ এঁরা অর্থের বিনিময়ে বেশি ফিচার ব্যবহার করে থাকেন, বিনা মূল্যের ব্যবহারকারীরা যা অতটা পারেন না। 

কিন্তু জনসংখ্যাগত সমস্যা তৈরি হয়েছে। টিন্ডার যখন প্রথম বাজারে আসে, তখন মিলেনিয়াল প্রজন্মের মানুষ ছিলেন তাদের সবচেয়ে বড় গ্রাহক। কিন্তু এর মধ্যে এই প্রজন্মের অধিকাংশ মানুষই বিয়ে করেছেন। এর অর্থ হলো, তাঁরা ডেটিং অ্যাপ ছেড়ে গেছেন। এখন টিন্ডারের মূল গ্রাহক হচ্ছেন জেন-জি প্রজন্মের মানুষ। তাঁদের বয়স কম এবং আয়ও খুব বেশি নয়। ফলে তাঁরা অর্থের বিনিময়ে অ্যাপ ব্যবহারে খুব একটা আগ্রহী নন। 

বাম্বল সম্প্রতি চলতি বছর তাদের রাজস্ব আয় কমবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের জন্য যতই চেষ্টা করুক না কেন, তারা হালে খুব একটা পানি পাচ্ছে না। কোম্পানিটির পূর্বাভাস, চলতি বছর তাদের রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হবে এক থেকে দুই শতাংশ, যদিও এর আগে তাদের পূর্বাভাস ছিল ৮ থেকে ১১ শতাংশ। ওয়াল স্ট্রিটেরও পূর্বাভাস ছিল, এই কোম্পানির রাজস্ব প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। 

চলতি আগস্ট মাসের শুরুতেই বাম্বল তাদের পূর্বাভাস ঘোষণা করার পর কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ৩২ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। 

২০২১ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। এরপর চলতি বছরে ফেব্রুয়ারি মাসে এটির শেয়ারের রেকর্ড দরপতন ঘটে। তখন মূলত রাজস্ব আয়ের পূর্বাভাস কমে যাওয়ায় শেয়ারের এমন রেকর্ড দরপতন হয়। এদিকে বাম্বলের শেয়ারের দাম কমলেও সম্প্রতি টিন্ডারের মালিক প্রতিষ্ঠান ম্যাচ গ্রুপের শেয়ারের দাম কিছুটা বেড়েছে। 

ফোর্বস হেলথ যে ব্যবহারকারীদের ওপর গবেষণা করেছিল, তাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই প্রতিদিন গড়ে ৫১ মিনিটের বেশি ডেটিং অ্যাপে সময় কাটিয়েছেন। উত্তরদাতাদের মধ্যে নারীরা ৫২ মিনিট ও পুরুষেরা ৪১ মিনিট সময় কাটিয়েছেন এসব অ্যাপে। এই সমীক্ষার বিষয়ে গবেষকেরা বলেন, মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, এই অ্যাপে উল্টো দিকের মানুষকে কেবল ফোনের মাধ্যমে চেনা যায় না; বাস্তবে তাঁদের ভিন্ন রূপই বেশি দেখা যায়।