ইসরায়েল–হামাস সংঘাতের বলি হতে পারে ভারত–ইউরোপ বাণিজ্য করিডর
দশকের পর দশক ধরে চলছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত। তবে গত শনিবার ইসরায়েলের ভেতরে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের হামলা এ সংঘাতের ক্ষেত্রে একটি নতুন ও প্রাণঘাতী অধ্যায়ের সূচনা করেছে। আর একই সঙ্গে সংঘাতের এই রূপ একটি উচ্চাভিলাষী বাণিজ্য পথকে বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
এই পথের পরিচিতি ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর (আইএমইসি)। গত মাসে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সময় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এ ধারণাটি আলোর মুখ দেখে। জি-২০ সম্মেলনের সময় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ভারত, সৌদি আরব, ফ্রান্স ও জামার্নি এই করিডরের ঘোষণা দেয়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) পশ্চিমা জবাব হিসেবে এই করিডরকে দেখা হচ্ছে। তবে এই উদ্যোগকে এখনো অনেক কিছু প্রমাণ করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের সর্বশেষ দফার সংঘাত প্রতিবেশী দেশগুলোকে এই প্রকল্পে বড় পরিমাণে অর্থ ঢালতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে বাধ্য করবে।
রেলপথ, বন্দর ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি—এই বাণিজ্য পথের অন্যতম অনুষঙ্গ। ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডরের সমর্থনকারীরা এই উদ্যোগের সম্ভাবনা নিয়ে খুবই আশাবাদী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মনে করছেন এই প্রকল্প ‘সত্যিই বড় কিছু’। অন্যদিকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েন একে বর্ণনা করেছেন ‘মহাদেশ ও সভ্যতার মধ্যে সবুজ ও ডিজিটাল সেতু’ হিসেবে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই করিডর নিয়ে শুরু থেকেই খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তাঁর মতে, আইএমইসি হলো ‘অনাগত শত শত বছরের জন্য বিশ্ব বাণিজ্যের ভিত্তি’। ধনী দেশগুলোর জোট জি-৭ বিশ্বজুড়ে অবকাঠামো তৈরিতে ২০২৭ সালের মধ্যে ৬০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের যে পরিকল্পনা করছে, আইএমইসি সেই পরিকল্পনার একটি অংশ।
আইএমইসি হবে দুটো আলাদা বহুমাত্রিক যোগাযোগব্যবস্থার যোগফল। আগে এটি ভারতকে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোয় সংযুক্ত করবে। আর উত্তর অংশে আরব অঞ্চলকে সংযুক্ত করবে ইউরোপের সঙ্গে। সব মিলিয়ে এশিয়া, উপসাগর ও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক মিলন ঘটাবে এই করিডর।
আইএমইসির অবশ্য বড় সম্ভাবনা রয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে পণ্য পরিবহনের সময় ৪০ শতাংশ কমবে। একই সঙ্গে সম্ভাব্য এই বাণিজ্য পথের চাহিদাও রয়েছে। গত দুই বছরে সৌদি আরবের সঙ্গে ভারতে বাণিজ্য দ্বিগুণ হয়ে ২০২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
তবে ভারতের জন্য এই প্রকল্পের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। এই বাণিজ্য পথ তাদেরকে ইউরোপের সঙ্গে একটি শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। ইউরোপ হলো ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার।
ভারতের সঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্ক বেশ উষ্ণ। কিন্তু এই করিডর গড়ে তুলতে হলে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি নির্ভরযোগ্য যোগাযোগব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। কারণ, ইউরোপে পণ্য পাঠানো হবে ইসরায়েলের হাইফা বন্দর ব্যবহার করে। ভারতের আদানি গোষ্ঠী চলতি বছর এ বন্দরটি কিনে নিয়েছে।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে এখন যা ঘটছে, তাতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের জন্য ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আরব বিশ্বের মানুষের আবেগ-অনুভূতি এখন গাজার পক্ষে। আর সেখানেই ইসরায়েল প্রতিশোধমূলক হামলা চালাচ্ছে।
ইসরায়েল যেভাবে রিজার্ভ সৈন্য ডেকে পাঠিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে তারা রেকর্ডসংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ ঘটাতে চলেছে। ফলে মাত্র কিছুদিন আগেও মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিস্থিতি ছিল, তা আর থাকবে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সংঘাতে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। এই সংখ্যা বাড়তে থাকবে বলেই আশঙ্কা।
আইএমইসি একটি দীর্ঘমেয়াদি দর্শন। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে চীনেরও পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু চীনের নিজস্ব অবকাঠামো প্রকল্প এখন ঋণের সংকটে পড়েছে। ফলে তাদের পরিকল্পনাও আপাতত হয়তো আলোর মুখ দেখবে না।
ফলে নিকট ভবিষ্যতে সুয়েজ খালই ভারত থেকে ইউরোপে পণ্য পাঠানোর মূল পথ হিসেবে থেকে যাবে। অন্যদিকে তুরস্কও একটি বিকল্প বাণিজ্য পথ নিয়ে পরিকল্পনা করছে।
যুদ্ধ কেউই চায় না। তবে যুদ্ধই আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে যে বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থ প্রবাহের পথ নতুন করে তৈরি করা বেশ কঠিন একটি কাজ।