এশিয়ার শীর্ষ তালিকায় চীন ও ভারতের ধনীরা
মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, এশিয়ার শীর্ষ ১০ ধনীর মধ্যে চারজনই চীনের। আর ভারতের তিনজন। এই দুটি দেশ এখন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকা শক্তি।
এশিয়া এখন বিশ্বের প্রবৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। ফলে এশিয়ার অর্থনীতি ও ধনীদের বিষয়ে বিশ্বের মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। সম্প্রতি ধুমধাম করে ছেলের প্রাক্বিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করে সারা বিশ্বে সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছেন ভারতের শীর্ষ ধনী মুকেশ আম্বানি। বিল গেটস ও মার্ক জাকারবার্গের মতো বিশ্বের শতকোটিপতিরা সেই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। এমনকি মুকেশ আম্বানির ছেলে অনন্ত আম্বানির হাতঘড়ি দেখে মার্ক জাকারবার্গের স্ত্রী রীতিমতো চমকে উঠেছেন। সেই ভিডিও ফুটেজ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস-এর সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, ভারতের মুকেশ আম্বানি এখন এশিয়ার শীর্ষ ধনী; গতকাল ১০ মার্চ বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত তাঁর সম্পদমূল্য ছিল ১১৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ৬৪০ কোটি মার্কিন ডলার। জানা যায়, ছেলের প্রাক্বিয়ে অনুষ্ঠানেই মুকেশ আম্বানি ১ হাজার ২৫৯ কোটি রুপি ব্যয় করেছেন।
বিভিন্ন খাতে ব্যবসা আছে মুকেশ আম্বানির। তিনি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ২০০৮ সালে তিনি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ আইপিএলের দল মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের মালিক হন। রিলায়েন্সের টেলিকমের জিও এখন ভারতের বৃহত্তম ব্রডব্যান্ড সেবা; তাদের গ্রাহকসংখ্যা প্রায় ৪৫ কোটি। এ ছাড়া গত বছরের আগস্ট মাসে তাঁদের জিও ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বাজারে আসে; এর মধ্য দিয়ে তাদের ব্যবসার পরিধি আরও বৃদ্ধি পায়।
বিশ্বের প্রথম সারির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠার লক্ষ্যে তিনটি খাতে জোর দিচ্ছেন মুকেশ আম্বানি। প্রথমত, ডিজিটাল পরিসেবা ও কৃত্রিম মেধা ব্যবহারে নেতৃত্ব দেওয়া। দ্বিতীয়ত, দক্ষ মানবসম্পদ নিয়োগ দিয়ে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়া; তৃতীয়ত, কর্মসংস্কৃতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসা।
সে জন্য ভারতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষির মতো ক্ষেত্র ও কর্মসংস্থান তৈরিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তিতে জোর দিচ্ছে রিলায়েন্স। মুকেশ আম্বানি মনে করেন, সে জন্য দক্ষ কর্মী নিয়োগ দিতে হবে। ডিজিটাল পরিষেবা, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, খুচরা ব্যবসা, তেলসহ বিভিন্ন ব্যবসা ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। তার আশা, সব মিলিয়ে বিশ্বের প্রথম ১০টি কোম্পানির একটি হয়ে ওঠার ক্ষমতা আছে রিলায়েন্সের।
এশিয়ার দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী গৌতম আদানির গতকাল পর্যন্ত সম্পদমূল্য ছিল ৮৪ বিলিয়ন বা ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। একসময় তিনি বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ ধনী ছিলেন। কিন্তু ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে হিনডেনবার্গ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর তার সাজানো বাগান লন্ডভন্ড হয়ে যায়। পরে অবশ্য অনেকটা ঘুরে দাঁড়ান তিনি। ফোর্বস-এর বিশ্বের শীর্ষ ধনীর তালিকায় তাঁর অবস্থান এখন ১৭তম। ভোগ্যপণ্য থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বন্দরের ব্যবসা আছে তাঁর। ভারতের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরও পরিচালনা করে আদানি গোষ্ঠী।
এশিয়ার ধনীদের মধ্যে তৃতীয় স্থানে আছেন বেভারেজ ও ওষুধের ব্যবসায়ী ঝং শ্যানশ্যান; একই সঙ্গে তিনি চীনের শীর্ষ ধনীও। একসময় আলিবাবার প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা চীনের শীর্ষ ধনী ছিলেন; কিন্তু ২০২১ সালে জ্যাক মাকে ছাড়িয়ে চীনের শীর্ষ ধনীর তালিকায় জায়গা করে নেন ঝং শ্যানশ্যান। নংফু স্প্রিং মিনারেল ওয়াটার কোম্পানির মালিক ষাটোর্ধ্ব ঝংয়ের ভাগ্য ২০২০ সাল থেকে ঘুরতে শুরু করে। করোনা মহামারিতে তাঁর ওষুধ কোম্পানি ওয়ানতাই বায়োলজিক্যাল ফার্মেসির শেয়ারের দর বহুগুণ বেড়ে যায়। গতকাল তাঁর সম্পদমূল্য ছিল ৬২ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ৬ হাজার ২৩০ কোটি ডলার।
চীনের প্রযুক্তি খাতের মহিরুহ প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সের প্রতিষ্ঠাতা ঝ্যাং ইমিং এখন দেশটির দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী। একই সঙ্গে এশিয়ার ধনীদের তালিকায় তাঁর অবস্থান চতুর্থ। বিপুল জনপ্রিয় ভিডিও অ্যাপ টিকটকের মূল প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাইট ড্যান্স। চীনের রাজধানী বেইজিংয়ের এক চার কক্ষের অ্যাপার্টমেন্টে ২০১২ সালে বাইট ড্যান্সের যাত্রা শুরু হয়। এরপর টিকটকের জনপ্রিয়তার সঙ্গে তাঁর সম্পদমূল্যও বেড়েছে। গতকাল বিকেল চারটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় ঝ্যাং ইমিংয়ের সম্পদমূল্য ছিল ৪৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৩৪০ কোটি ডলার। বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় তাঁর অবস্থান ছিল ২৮তম।
এশিয়ার শীর্ষ ধনীদের তালিকায় এরপর আছেন ভারতের শিব নাদার। গতকাল বিকেল পর্যন্ত তাঁর সম্পদমূল্য ছিল ৩৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৬৯০ কোটি ডলার। ভারতের শীর্ষ দানশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত শিব নাদার। বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) পরিষেবা এইচসিএলের সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিনি প্রায় ২ হাজার ৪২ কোটি রুপি দান করেছেন। সেই হিসাবে তিনি দৈনিক দান করেছেন প্রায় ৫ দশমিক ৬ কোটি রুপি। বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় গতকাল তাঁর অবস্থান ছিল ৪১তম।
চীনের আরেক শীর্ষ ধনী কলিন হুয়াং আছেন এশিয়ার শীর্ষ ধনীর তালিকায় ষষ্ঠ অবস্থানে। চীনের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান পিডিডি হোল্ডিংসের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ২০২১ সালে এই কোম্পানির চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করলেও তিনি এখনো এই কোম্পানির বৃহৎ শেয়ারহোল্ডার। গতকাল তাঁর সম্পদমূল্য ছিল ৩৬ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৬২০ কোটি ডলার। কলিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর মাইক্রোসফটে ইন্টার্নশিপ করেছেন; এরপর ২০০৪ সালে তিনি গুগলে কর্মজীবন শুরু করেন।
এশিয়ার শীর্ষ ধনীদের তালিকায় সপ্তম থেকে দশম অবস্থানে আছেন যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়ার প্রাজোগো পাঙ্গেসতু; জাপানের তাদাশি ইয়ানাই অ্যান্ড ফ্যামিলি; হংকংয়ের লি কা শিং ও চীনের মা হুয়াতেং।
তালিকায় আরও যারা
এর বাইরে এশিয়ার শীর্ষ ধনীদের তালিকায় আরও আছেন চীনের মা হুয়াতেং। চীনের ইন্টারনেট কোম্পানি টেনসেন্টের কর্ণধার এই হুয়াতেং। ব্যাপক জনপ্রিয় অনলাইন গেম পাবজি মোবাইলের মূল মালিক এরা। সেই সঙ্গে চীনের জনপ্রিয় মেসেজিং অ্যাপ উইচ্যাটেরও মালিক এই টেনসেন্ট। তাঁর সম্পদমূল্য ৩২ দশমিক ১ বা ৩ হাজার ২১০ কোটি ডলার।
স্কুলের চার বন্ধুকে নিয়ে ১৯৯৮ সালে টেনসেন্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চীনের শেনজেন ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানে স্নাতক হুয়াতেং। তিনি চীনে ‘পনি মা’ নামেও পরিচিত। ২০০৭, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে হুয়াতেংকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালীদের একজন ঘোষণা করেছিল বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন। ২০১৫ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের মধ্যে নাম ছিল হুয়াতেংয়ের। গতকাল এ প্রতিবেদন লেখার সময় তাঁর সম্পদমূল্য ছিল ৩০ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ২০ কোটি মার্কিন ডলার। বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় তাঁর অবস্থান ছিল ৫৬তম।
স্বাভাবিকভাবেই এশিয়ার শীর্ষ ধনীদের তালিকায় ভারত ও চীনের ধনীদের প্রাধান্য বেশি। দুটি দেশ এখন বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকা শক্তি। তবে এই দুই দেশে ধনীদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বোঝা যায়, এসব দেশে বৈষম্যও বেশি।