ঋণসংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কাকে বাঁচাতে বিশ্বের ১৮০ জন অর্থনীতিবিদ ও একাডেমিশিয়ান ঋণদাতাদের প্রতি দেশটির ঋণ মওকুফের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে কেউ কেউ আবার মনে করছেন, ঋণ মওকুফ করা হলেই শ্রীলঙ্কার সংকটের সমাধান হবে না।
বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫২ বিলিয়ন বা ৫ হাজার ২০০ কোটি ডলার। এই ঋণের ৪০ শতাংশ বেসরকারি ঋণদাতাদের কাছ থেকে নেওয়া, যার মধ্যে বহুজাতিক সংস্থাও আছে। বাকিটা দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে নেওয়া, যার মধ্যে দেশটি সবচেয়ে বেশি নিয়েছে চীনের (৫২%) কাছ থেকে, তারপর আছে জাপান (১৯%) ও ভারত (১২%)। খবর আল-জাজিরার।
কিন্তু দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমতে থাকায় গত বছরের এপ্রিল মাসে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে খেলাপি হয়ে পড়ে। এরপর তারা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে ২৯০ কোটি ডলারের বেইল আউটের আবেদন করে। এ নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু আইএমএফ বলেছে, ভারত ও চীনের মতো দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতারা যদি শ্রীলঙ্কার ঋণ স্থগিত করে বা সে রকম ব্যবস্থা নেয়, তাহলে তারা ঋণ দেবে। অর্থাৎ তারা যত দিন না নিশ্চিত হচ্ছে যে শ্রীলঙ্কা ঋণ পরিশোধ করতে পারবে, তত দিন তারা ঋণের অর্থ ছাড় করবে না।
১৮০ জন অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশারদের মধ্যে আছেন বিশ্বখ্যাত ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি ও ভারতের অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষ। তাঁরা আবেদনে বলেছেন, বেসরকারি ঋণদাতারা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই না করে রাজনীতিকদের ঘুষ হিসেবে উচ্চ সুদের ঋণ দিয়েছে। এদের অনেকেই ঋণের বড় একটা অংশ ফেরত পেয়েছে। অর্থাৎ তারা লাভবান হয়েছে। কিন্তু এখন যখন শ্রীলঙ্কা বিপদে পড়েছে, তখন তাদেরও দায় নিতে হবে। অর্থাৎ এই ঋণ বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছেন সেই ১৮০ জন।
কিন্তু সবাই আবার এর সঙ্গে একমত নন। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ডব্লিউ এ ভিজেবর্ধনে মনে করেন, এভাবে ঋণ বাতিল করা হলে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থাই ধসে পড়বে। এই ১৮০ জনের সবাই কিন্তু অর্থনীতিবিদ নন, তাঁদের মধ্যে অনেক সামাজিক বিজ্ঞানের মানুষও আছেন। তাঁদের এই আহ্বান মেনে নেওয়া হলে নতুন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হবে।
ভিজেবর্ধনে আরও বলেন, ‘বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একধরনের আন্তনির্ভরশীল ও আন্তসংযুক্ত ব্যবস্থা, এটা ভেঙে পড়লে বিশ্বই ভেঙে পড়বে। আবার এরপর কী হবে, আমরা কেউ তা জানি না।’ তিনি এটা দেখে অবাক হয়েছেন যে ড্যানি রডরিকের মতো ওয়াশিংটন কনসেনসাসের পাঁড় সমর্থক ও টমাস পিকেটির মতো বামপন্থী অর্থনীতিবিদ এ বিষয়ে এককাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন।
তাহলে করণীয় কী, আল–জাজিজার এমন প্রশ্নের জবাবে ভিজেবর্ধনে বলেন, শাসকগোষ্ঠী ঋণ নিয়ে নয়ছয় করেছে। তাদের জন্য জনগণ বিপদে পড়েছে। ফলে শাসকগোষ্ঠীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে, যাতে এ ধরনের অপরাধ যারা করে, তারা পার না পায়।
আর ঋণ বাতিল করা হলে কিন্তু জনগণ নয়, সেই শাসকগোষ্ঠীই উপকৃত হবে। কারণ, তখন তো ঋণ পরিশোধ করতে হবে না, বরং শাসকেরা আরও ঋণ করতে পারবেন। আবারও তাঁরা নয়ছয় করতে পারবেন।
কেন এই সংকট
‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার’ চর্চা শ্রীলঙ্কার অনেক পুরোনো। মাহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই এই রীতি ছিল শ্রীলঙ্কায়। রাজপক্ষে ক্ষমতায় আসার পর চমক দেখাতে নানা ধরনের প্রকল্প হাতে নিতে শুরু করেন। তাতে শ্রীলঙ্কার মোট জাতীয় ঋণ জিডিপির ১১০ শতাংশের মতো (যা নিরাপদ সীমার প্রায় দ্বিগুণ)। কিন্তু এসব প্রকল্প লাভজনক হয়নি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, রাজাপক্ষের আমলে বিদেশি ঋণ বেড়ে যাওয়া আর দেশটির বিদেশি ঋনের বড় অংশই সার্বভৌম ঋণ, যার মেয়াদ যেমন কম, তেমনি সুদহার বেশি। ফলে হঠাৎ করে বিপুল ঋণ পরিশোধ করতে হওয়ায় বিপদে পড়ে দেশটি।
উল্লেখ করা দরকার, রাজাপক্ষে ক্ষমতায় আসার আগেই শ্রীলঙ্কায় ঋণ জিডিপির অনুপাত ছিল ৮০ শতাংশ।
এদিকে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম খাত পর্যটন আবার চাঙা হচ্ছে। তাতে দেশটির সক্ষমতা এ বছর কিছুটা বাড়বে বলে আশা করছেন বিশ্লেষকেরা।