চলতি ২০২৫ সালের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামীদামি কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তারা (সিইও) আশাবাদের মধ্য আছেন। তাঁরা মনে করেন, এ বছর ব্যবসা-বাণিজ্য ভালো হবে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছু হুমকিও চিহ্নিত করেছেন তাঁরা।
বৈশ্বিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটারহাউসকুপার্সের(পিডব্লিউসি) ‘বৈশ্বিক প্রধান নির্বাহী জরিপ’–এ এমন তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে প্রধান নির্বাহীদের বেশ কয়েকটি ঝুঁকির তালিকা দেওয়া হয়েছিল। সেই ঝুঁকিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হিসেবে তারা চিহ্নিত করেছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে। জরিপে অংশ নেওয়া ২৯ শতাংশ প্রধান নির্বাহীই এটাকে প্রধান ঝুঁকি হিসেবে উল্লেখ করেন। এর ঠিক পেছনেই আছে মূল্যস্ফীতি, যেটির কথা বলেছেন ২৭ শতাংশ প্রধান নির্বাহী। অন্য ঝুঁকিগুলোর মধ্য রয়েছে যথাক্রমে সাইবার নিরাপত্তা, গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর অভাব, ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, প্রযুক্তিগত ঝুঁকি, জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক অসমতা।
জরিপে প্রতি পাঁচজন সিইওর মধ্যে তিনজনই বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি প্রকৃতি নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন; অর্থাৎ ৬০ শতাংশ সিইও মনে করেন, আগামী ১২ মাসে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার বাড়বে। গত বছর প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধির বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন ৩৮ শতাংশ। দুই বছর আগে এই হার ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ।
ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি বাড়লে জনবলও বাড়াতে হয়। জরিপে অংশ নেওয়া ৬০ শতাংশ প্রধান নির্বাহী বলেছেন, আগামী ১২ মাসে কোম্পানির জনবল বাড়বে। এর অর্ধেকের কমসংখ্যক; অর্থাৎ ৩০ শতাংশের কম প্রধান নির্বাহী জানিয়েছেন, তাঁরা জনবল কমাবেন। শুধু তা–ই নয়, যে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে এত উদ্বেগ, যেই প্রযুক্তির কারণে বেকারত্ব বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে, সেটির ব্যবহার নিয়েও সিইওরা কথা বলেছেন। তাঁদের ভাষ্য, এটি ব্যবহারের কারণে জনবল আরও বাড়াতে হয়েছে।
এ ছাড়া জেনারেটিভ এআই ব্যবহারের দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রভাব অনুভূত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিইওরা। ৫৬ শতাংশ সিইও জানান, এআই ব্যবহারের ফলে জনশক্তির কর্মদক্ষতা বেড়েছে। সেই সঙ্গে এক-তৃতীয়াংশ সিইও (৩৪ শতাংশ) মুনাফা ও ৩২ শতাংশ সিইও রাজস্ব বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন; অর্থাৎ পরিবর্তন আসছে। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন কোম্পানির পথ পরিক্রমায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। ৪২ শতাংশ সিইও মনে করেন, আগামী ১০ বছরে নতুন উদ্ভাবন না হলে তাঁদের কোম্পানি ব্যবসার যোগ্যতা হারাবে। ৪০ শতাংশ জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে তাঁরা নতুন খাতে কাজ শুরু করেছেন।
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনও ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠছে বলে মন করেন সিইওরা। তাঁরা বলেছেন, জলবায়ু–সংক্রান্ত বিনিয়োগের কারণে রাজস্ব হ্রাস নয়; বরং রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে।
জলবায়ু ও এআই
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়; ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে চ্যাটজিপিটি এআইভিত্তিক বট বাজারে এনে তাক লাগিয়ে দেয়। এআই নিয়ে অনেক দিন ধরেই কথা হচ্ছিল। কিন্তু চ্যাটজিপিটি আসার আগে এর ব্যবহারকারী বা সিইও, কেউই ঠিক ভাবতে পারেননি, এটির কী ক্ষমতা।
এরপর শুরু হয় এআই খাতে বিনিয়োগের প্রতিযোগিতা।
দুই বছর এই খাতে বিনিয়োগের প্রতিযোগিতা করার পর সিইওরা এখন দেখছেন, ফলাফল খারাপ নয়; বরং ভালো। এআই ব্যবহারের কারণে দক্ষতা, রাজস্ব আয় ও মুনাফা বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে। যদিও এক বছর আগে সিইওরা এআই ব্যবহার করে যতটা মুনাফা ও রাজস্ব বৃদ্ধির আশা করেছিলেন, গত বছর ঠিক ততটা হয়নি। তারপরও তাঁরা আশাহত হননি। আগামী বছরগুলোতে এআই ব্যবহারের আরও ফল পাওয়া যাবে বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন। জরিপে অংশ নিয়ে ৪৯ শতাংশ সিইওর আশা, আগামী এক বছরে তাঁদের মুনাফা বাড়বে।
আগামী তিন বছরের পরিকল্পনা সম্পর্কে সিইওরা বলেছেন, তাঁদের মূল অগ্রাধিকার হবে প্রযুক্তিগত প্ল্যাটফর্ম, ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া ও কাজের প্রবাহের মধ্যে এআইকে যুক্ত করা। এআই ব্যবহার করে নতুন পণ্যসেবা নিয়ে আসার কৌশল পুনঃপ্রণয়ন করার ক্ষেত্রে খুব বেশি সিইও সিওর পরিকল্পনা নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, মাত্র এক-তৃতীয়াংশ সিইও কর্মী বাহিনী ও দক্ষতা কৌশলের মধ্যে এআই যুক্ত করার পরিকল্পনা করছেন বলে জানান। পিডব্লিউসি মনে করছে, এটা ভুল পদক্ষেপ। তারা মনে করছে, কর্মীদের এআই ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে, কখন ও কোথায় তা ব্যবহার করতে হবে, সে বিষয়ে জানলেই তা সবচেয়ে কার্যকর হবে।
জরিপে দেখা গেছে, ভূরাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রতিকূলতা সামলে নেওয়ার পর কোম্পানিগুলো জলবায়ু–সংক্রান্ত বিনিয়োগ করলে মুনাফা বাড়ছে। গত বছরের জরিপেও একই ফল পাওয়া গেছে; অর্থাৎ জলবায়ু–সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য ও তার সঙ্গে কোম্পানির আর্থিক পারফরম্যান্স শক্তিশালী হওয়ার সংযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের এক গবেষণায়ও তার ধারাবাহিকতা দেখা গেছে। যেসব কোম্পানি জলবায়ু পরিবর্তন খাতে বিনিয়োগ করছে, তাদের রাজস্ব বৃদ্ধির হারও বাড়ছে।
এই জরিপে বিশ্বের ১০৯টি দেশের ৪ হাজার ৭০১ জন সিইও বা প্রধান নির্বাহী অংশ নিয়েছেন। ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর থেকে শুরু করে ৮ নভেম্বর পর্যন্ত জরিপটি করা হয়। জরিপে অংশ নেওয়া সিইওদের মধ্যে ৪ হাজার ২৩৬ জন পুরুষ, ৪০১ জন নারী; ৬৪ জন তাঁদের লৈঙ্গিক পরিচয় দিতে চাননি।
এই সিইওদের মধ্যে ৬২ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিতে কাজ করেন। ৩৬ শতাংশ কাজ করেন এমন কোম্পানিতে, যার রাজস্ব আয় ১০ কোটি ডলার পর্যন্ত; ৩৩ শতাংশ কোম্পানির রাজস্ব আয় ১০ কোটি থেকে ১০০ কোটি ডলার; ২০ শতাংশ কোম্পানির রাজস্ব ১০০ কোটি ১ হাজার কোটি; ৩ শতাংশের রাজস্ব আয় ১ হাজার কোটি ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার; ৩ শতাংশের রাজস্ব আয় ২৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।