যেভাবে ৯টি শেয়ারের মালিকের কারণে সাড়ে ৫ হাজার কোটি ডলার খুইয়েছেন ইলন মাস্ক
গত সপ্তাহে ইলন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের ইতিহাসে অন্যতম বড় ক্ষতির শিকার হয়েছেন। টেসলার প্রধান নির্বাহী এ সময় ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বেতন–ভাতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যে মামলার কারণে তাঁকে ওই পরিমাণ অর্থ বিসর্জন দিতে হয়েছে, সেই মামলা অবশ্য তাঁর পর্যায়ের কেউ করেননি। করেছিলেন একজন সাবেক হেভি মেটাল ড্রামবাদক।
রিচার্ড টরনেটা ২০১৮ সালে ইলন মাস্কের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছিলেন। ওই সময় পেনসিলভানিয়ার এই বাসিন্দার হাতে টেসলার মাত্র ৯টি শেয়ার ছিল। মামলাটি শেষ পর্যন্ত বিচারে গড়ায় ২০২২ সালে। গত মঙ্গলবার দেওয়া বিচারকের রায় রিচার্ড টরনেটার পক্ষে যায়। ইলন মাস্ক নিজের জন্য যে বিপুল বেতন–ভাতা ঠিক করেছিলেন, আদালতের রায়ে তা বাতিল করে বলা হয়েছে যে এর মাধ্যমে টরনেটা ও তাঁর মতো শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি ন্যায় আচরণ করা হয়নি।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স রিচার্ড টরনেটার মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করতে পারেনি। আর তাঁর আইনজীবী এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
টরনেটার মামলার আগে ইলন মাস্কের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা হয়েছিল, যেসব মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে মানহানি, শেয়ারহোল্ডারদের প্রতি দায়িত্বপালন না করা ও শেয়ারবাজারসংক্রান্ত আইন ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছিল। কিন্তু ওই সব মামলায় মাস্ক টিকে গিয়েছিলেন।
অনলাইন ঘেঁটে রিচার্ড টরনেটা সম্পর্কে যা জানা গেছে, তা হলো তিনি গাড়িপ্রেমীদের জন্য গানবাজনার যন্ত্রপাতি বানাতে যতটা পছন্দ করেন, বড় কোম্পানির অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়তে তাঁর ততটা আগ্রহ নেই। যেসব যন্ত্রপাতি বানিয়েছেন, সেসবের ভিডিও তিনি অনলাইনে পোস্ট করেছেন। কীভাবে তিনি তাঁর ভ্রু পুড়িয়ে ফেলেছেন, তা নিয়েও তিনি ভিডিও দিয়েছেন।
নিজের বিলুপ্ত ব্যান্ড ‘ডন অব কারেকশন’ নিয়ে রিচার্ড টরনেটা নিউইয়র্কের সিবিজিবি ক্লাবে ড্রাম বাজাচ্ছেন, এমন ভিডিও অনলাইনে আছে।
সামাজিক মাধ্যমে টেসলা ও মাস্কের ভক্তরা অবশ্য এই মামলার রায়কে বিচারের নামে প্রহসন হিসেবে বর্ণনা করছেন। টরনেটার উদ্দেশ্য এবং রাজনৈতিক সংযোগ নিয়েও তাঁরা আলোচনা করছেন। এমন প্রশ্নও তোলা হয়েছে যে এত কম শেয়ার নিয়ে তিনি এত ক্ষমতার অধিকারী কীভাবে হলেন।
মাস্কের বেতন–ভাতা
রায়টি এসেছে ডেলাওয়ার অঙ্গরাজ্যের কোর্ট অব চ্যান্সারি থেকে। ২০১৮ সালে ইলন মাস্ক যে বেতন–ভাতার জন্য টেসলার পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছান, সেটি ছিল একটি রেকর্ড। সেই ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বেতন–ভাতার চুক্তিই বিচারক বাতিল করে দেন। তাঁর কথায়, ‘অতল এই পরিমাণ’ শেয়ারহোল্ডারদের জন্য অন্যায্য।
ইলন মাস্ক কেবল টেসলারই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নন। একই সঙ্গে তিনি আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানির নেতৃত্বে আছেন, যার মধ্যে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ও মহাকাশবিষয়ক কোম্পানি স্পেসএক্স। এর বাইরে রয়েছে মাটি খুড়ে টানেল তৈরি করার বোরিং কোম্পানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোম্পানি এক্সএআই ও আলোচিত কোম্পানি নিউরালিংক। শেষের এই কোম্পানি গত সপ্তাহে মানুষের মস্তিষ্কে চিপ স্থাপন করেছে, যার উদ্দেশ্য হলো মানুষের মস্তিষ্কের সঙ্গে কম্পিউটারের সংযোগ স্থাপন।
ডেলাওয়ার রাজ্যের আদালতে জানানো হয়েছে যে আমেরিকার করপোরেট ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি বেতন–ভাতার এই প্যাকেজ ইলন মাস্ককে দিয়েছেন টেসলার পরিচালনা পর্ষদের সদস্যেরা, যাঁরা এই কোটিপতিকে খুশি রাখতে চান।
সমঝোতার অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে ইলন মাস্ককে ৩০ কোটি ৪০ লাখ শেয়ারের বিকল্প দেওয়া হয়, যা তিনি ২৩ ডলার ৩৩ সেন্ট দরে কিনতে পারবেন। মঙ্গলবার টেসলার একটি শেয়ারের দামই ছিল ১৯১ ডলার ৫০ সেন্ট। অর্থাৎ, বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে তিনি টেসলার শেয়ার কেনার সুযোগ পান পরিচালনা পর্ষদের বদৌলতে।
ইলন মাস্ককে যখন ওই শেয়ার অপশন দেওয়া হয়, তখন টেসলার মূল্যমান ছিল ৫ হাজার কোটি ডলার। ২০২১ সালে এই কোম্পানির মূল্যমান দাঁড়ায় ১ লাখ কোটি ডলারে।
টেসলায় নিজের শেয়ারের সংখ্যা আরও বাড়াতে চান মাস্ক। বাইরের কেউ যাতে টেসলার নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারেন, সে কারণে তিনি শেয়ার বাড়াতে চান বলে সম্প্রতি বলেছেন। পরিচালনা পর্ষদের কাছে তিনি এ ব্যাপারে তাঁর প্রস্তাবও দিয়েছেন।
এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘২৫ শতাংশ ভোটের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া টেসলাকে এআই ও রোবোটিকসে নেতৃত্বের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমি অস্বস্তিকর অবস্থায় আছি। আমার প্রভাব আছে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সেটা না হলে আমি টেসলার বাইরে পণ্য বানাতেই বেশি পছন্দ করব।’
শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা
রিচার্ড টরনেটার মামলা আমেরিকার করপোরেট জগৎকে নাড়া দিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কলাম্বিয়া ল স্কুলের শিক্ষক এরিক টালি বলেন, বেশ কিছু আইনি প্রতিষ্ঠান এমন অনেক বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে কাজ করে, যাতে তারা নতুন নতুন মামলা করতে পারে। এসব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে পেনশন তহবিলের মতো প্রতিষ্ঠান আছে, তবে টরনেটার মতো একক ব্যক্তির সংখ্যাও কম নয়।
এরিক টালি বলেন, এসব বিনিয়োগকারীরা মামলার কাগজে সই করেই তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেন। তাঁরা আইনি প্রতিষ্ঠানকে কোনো অর্থও দেন না। এসব প্রতিষ্ঠান পরে নিজেরা মামলা চালায়। যেমনটা ঘটেছে ইলন মাস্কের মামলার ক্ষেত্রে।
তবে রিচার্ড টরনেটার মতো বিনিয়োগকারীদের লাভ হলো, তাঁরা কোম্পানির শত শত কোটি ডলার বাঁচান। টরনেটা যতটুকু লাভ পেয়েছেন, বাকি শেয়ারহোল্ডাররাও ঠিক একইভাবে লাভবান হয়েছেন। টেসলার ক্ষেত্রে একটি নতজানু পরিচালনা পর্ষদ ইলন মাস্ককে শত শত কোটি ডলার দিয়েছিল, যে অর্থ এখন বেঁচে গেল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোনো কোম্পানির পর্ষদে নজরদারির জন্য টরনেটার মতো লোকদের প্রয়োজন রয়েছে। আইনপ্রণেতা ও বিচারকেরা অনেক দিন ধরেই চাইছিলেন যে বিনিয়োগ কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিক। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, তহবিল ব্যবস্থাপকেরা এই কাজ করতে চান না, কারণ তাহলে ওয়ালস্ট্রিটের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক খারাপ হতে পারে।
আর সে কারণে রিচার্ড টরনেটার মতো মানুষকে ইলন মাস্কের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছে।
এরিক টালি বলেন, ‘করপোরেট আইনের ইতিহাসে তাঁর নাম এখন খোদাই করা থাকবে। আমার ছাত্ররা টরনেটা বনাম মাস্ক মামলার বিষয়বস্তু আগামী ১০ বছর ধরে পড়বে।’