টাটা ট্রাস্টের নতুন চেয়ারম্যান নোয়েল টাটা, পেলেন দ্বিতীয় সুযোগ
ভারতের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি রতন টাটার মৃত্যুর পর টাটা ট্রাস্টের দায়িত্ব পেয়েছেন তাঁর সৎভাই নোয়েল টাটা। টাটা ট্রাস্টের পরিচালনা পর্ষদ ৬৭ বছর বয়সী নোয়েলকে পরবর্তী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। গত বুধবার মুম্বাইয়ে মারা যান ৮৬ বছর বয়সী রতন টাটা।
নোয়েল টাটার পারিবারিক অবস্থান এবং টাটা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তাঁর পেশাগত অভিজ্ঞতার কারণে টাটা ট্রাস্টে রতন টাটার উত্তরসূরি হিসেবে নোয়েলকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হতো।
টাটা গোষ্ঠীর বেশ কয়েকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন নোয়েল টাটা। যেমন ট্রেন্ট, ভোল্টাস, টাটা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন ও টাটা ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। টাটা স্টিল ও ঘড়ি কোম্পানি টাইটানের ভাইস চেয়ারম্যান তিনি। এ ছাড়া স্যার রতন টাটা ট্রাস্টেরও একজন সদস্য নোয়েল।
টাটা গোষ্ঠীর প্রধান দুই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে টাটা সন্স ও টাটা ট্রাস্ট। এর মধ্যে টাটা গ্রুপের হোল্ডিং প্রতিষ্ঠান টাটা সন্স গোষ্ঠীটির ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলো (কোম্পানি) নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে টাটা ট্রাস্ট হলো দাতব্য সংস্থা; এটি আবার টাটা সন্সের বেশির ভাগ (৬৬ শতাংশ) শেয়ারের মালিক এবং টাটা গ্রুপের মূল্যবোধের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখে। মূলত মানবহিতৈষী টাটা ট্রাস্টের মাধ্যমেই টাটা সাম্রাজ্য পরিচালিত হয়।
তবে টাটা সন্সের চেয়ারম্যান ও টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের পদকে আলাদা করেছিলেন রতন টাটা। উদ্দেশ্য ছিল—উভয় প্রতিষ্ঠানের ওপরে একজন ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ বা খুব বেশি কর্তৃত্ব এড়ানো। ২০১২ সাল পর্যন্ত টাটা সন্সের চেয়ারম্যান ছিলেন রতন টাটা। এরপর টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হন তিনি। যদিও টাটা গ্রুপের সার্বিক বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
আর বর্তমানে টাটা সন্সের চেয়ারম্যান নটরাজন চন্দ্রশেখরন, যিনি চন্দ্র নামেই বেশি পরিচিত। টাটা সন্সের পরিচালনা পর্ষদে তিনি যোগ দেন ২০১৬ সালে। এক বছর পর তিনি চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। একই সঙ্গে তিনি টাটা গোষ্ঠীর বেশ কয়েকটি কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
পড়াশোনা ও কর্মজীবন
নোয়েল টাটার জন্ম ১৯৫৭ সালে। তিনি যুক্তরাজ্যের সাসেক্স ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে ফ্রান্সের ইনসিয়াদ (ইনস্টিটিউট ইউরোপিয়ান ডি’প্রশাসন দেস অ্যাফেয়ার্স) থেকে ইন্টারন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ প্রোগ্রাম (আইইপি) সম্পন্ন করেন।
টাটা গ্রুপে যোগদানের আগে নোয়েল যুক্তরাজ্যে নেসলেতে কাজ করতেন। ১৯৯৯ সালে টাটা গ্রুপের রিটেইল কোম্পানি ট্রেন্টে কাজ শুরু করেন নোয়েল। পরে ২০১৪ সালে তিনি ট্রেন্টের চেয়ারম্যান হন। ২০১০ সালে তিনি টাটা ইন্টারন্যাশনালে যোগ দেন। কোম্পানিটি চামড়াজাত পণ্য, খনিজ ও ধাতু রপ্তানি করে। এই প্রতিষ্ঠানে নোয়েল ২০২১ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। বর্তমানে তিনি টাটা গ্রুপের অন্য দুটি কোম্পানি—ভোল্টাস ও টাটা ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্বে পালন করছেন।
২০১৯ সালে স্যার রতন টাটা ট্রাস্টে এবং ২০২২ সালে স্যার দোরাবজি টাটা ট্রাস্টের পর্ষদ সদস্য হন নোয়েল টাটা। গত মে মাসে নোয়েল টাটার তিন সন্তানকেও টাটা ট্রাস্টের অধীনে পাঁচটি জনহিতকর সংস্থার পরিচালনা পর্ষদে নিযুক্ত করা হয়।
টাটা গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে টাটা ইন্টারন্যাশনালে নোয়েলের ভূমিকাকে সবচেয়ে বড় করে দেখা হয়। এটি টাটা গ্রুপের ট্রেডিং ও ডিস্ট্রিবিউশন শাখা। ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত নোয়েল এতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। এ সময়ে তাঁর নেতৃত্বে এটি ৫০০ মিলিয়ন (৫০ কোটি) ডলার থেকে ৩ বিলিয়ন (৩০০ কোটি) ডলারের কোম্পানিতে পরিণত হয়। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও তিনি ভালো ভূমিকা রেখেছেন।
টাটাদের পরবর্তী প্রজন্ম
রতন টাটার সৎভাই নোয়েল টাটা হলেন নাভাল টাটা ও সিমোন টাটার (নাভাল টাটার দ্বিতীয় স্ত্রী) ছেলে। তিনি আইরিশ নাগরিক হলেও তাঁর যাবতীয় কার্যক্রম ভারতকেন্দ্রিক। নোয়েল বিয়ে করেছেন প্রয়াত পালোনজি মিস্ত্রির মেয়ে ও প্রয়াত সাইরাস মিস্ত্রির বোন আলু মিস্ত্রিকে। মায়া ও লিয়া নামে তাঁদের দুই মেয়ে ও নেভিল নামে এক ছেলে রয়েছে।
টাটা গ্রুপের হোল্ডিং কোম্পানি টাটা সন্সে ভারতীয়-আইরিশ শাপুরজি পালোনজি পরিবারের ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। শাপুরজি পালোনজি গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান হলেন পালোনজি মিস্ত্রি; আর টাটা গ্রুপে একসময় চেয়ারম্যান ছিলেন সাইরাস মিস্ত্রি।
নোয়েল টাটার মেয়ে লিয়া (৩৯) টাটা এডুকেশন ট্রাস্ট, টাটা সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট ও সার্বজনিক ট্রাস্টে কাজ করছেন। আরেক মেয়ে মায়া (৩৬) টাটা এডুকেশন ট্রাস্ট ও সার্বজনিক ট্রাস্টের পাশাপাশি আরডি টাটা ট্রাস্টে যুক্ত রয়েছেন। আর ছেলে নেভিল (৩২) টাটা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব স্কিলসের (টিআইআইএস) বোর্ড সদস্য। তাঁদের তিনজনই আবার কলকাতায় অবস্থিত ক্যানসার হাসপাতাল টাটা মেডিকেল সেন্টারেরও ট্রাস্ট সদস্য। পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, উত্তরাধিকার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নোয়েল টাটা আগে থেকেই তাঁর ছেলেমেয়েদের এভাবে বিভিন্ন দায়িত্বে যুক্ত করেছেন।
দ্বিতীয় সুযোগ
প্রায় ১২ বছর আগে টাটা গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ অংশ টাটা সন্সের চেয়ারম্যান হওয়ার খুব কাছাকাছি গিয়েছিলেন নোয়েল টাটা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ওই পদে যেতে পারেননি। এর তিন বছর পরেই টাটা সন্সের চেয়ারম্যানের পদ ছেড়ে টাটা ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হন রতন টাটা।
ওই সময় টাটা সন্সের চেয়ারম্যান বাছাইয়ের জন্য একটি বোর্ড গঠন হয়েছিল। নতুন চেয়ারম্যানের কী যোগ্যতা থাকা উচিত, তা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন রতন টাটা। সেই যোগ্যতার বিচারে পিছিয়ে ছিলেন নোয়েল টাটা।
যাহোক, শেষ পর্যন্ত নোয়েলের শ্যালক সাইরাস মিস্ত্রি টাটা সন্সের চেয়ারম্যান হন। এতে অবশ্য অনেকে অবাক হয়েছিলেন। কারণ, টাটা গ্রুপ ও শাপুরজি পালোনজি গ্রুপের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে একটি টানাপোড়েনের সম্পর্ক ছিল। বলা হয়ে থাকে, ওই সময় রতন টাটা তাঁর পরবর্তী উত্তরসূরি হিসেবে নোয়েলকে যোগ্য মনে করেননি। এ কারণে বাছাইপ্রক্রিয়া থেকে বাদ পড়েন নোয়েল।
উল্লেখ্য, স্যার রতন টাটা ট্রাস্ট ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। নোয়েল টাটা হলেন ট্রাস্টের ষষ্ঠ চেয়ারম্যান। এ ছাড়া টাটা গোষ্ঠীর আরেক ট্রাস্ট স্যার দোরাবজি টাটা ট্রাস্টের ১১তম চেয়ারম্যানও তিনি। ২০২৩-২৪ সালে টাটার কোম্পানিগুলোর মোট রাজস্ব ছিল ১৬ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি। টাটা সন্সের হিসাবে, এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্মিলিতভাবে ১০ লাখের বেশি লোক কাজ করছেন।
সংবাদ সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ও এনডিটিভি।