বাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছেই কি লিজ ট্রাসের হার
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের পদত্যাগে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল। সেটা হলো, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ক্রমবর্ধমান নীতি সুদহার বৃদ্ধি রাজনীতিবিদদের চেনা গণ্ডি বদলে দিয়েছে। তাঁরা যে জনমুখী বা জনতুষ্টিবাদী রাজনীতি করতে এসব হাতিয়ার ব্যবহার করবেন, সেই সুযোগ সংকুচিত হয়ে গেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
২০০৭-০৮ সালের মন্দার পর উন্নত বিশ্ব ঋণের রাশ ছেড়ে দিতে নীতি সুদহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছিল। তাতে সরকারও বিপুল ঋণ নিয়েছে। বিনিয়োগকারীরাও তাতে মাথা ঘামাননি, চিন্তিত হওয়া তো দূরের কথা। কিন্তু সেই দিন শেষ বলে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে শেষমেশ এতে জনগণের ক্ষতি হলো বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সেটা হলো, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রাজনীতিকদের খেলার মাঠ সংকুচিত করে ফেলেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে নীতি সুদহার বৃদ্ধি করছে, তাতে সরকারের পক্ষে এখন বাছবিচার ছাড়া ঋণ নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, ঋণের সুদহার বাড়ছে। সরকার ঋণ নিতে চাইলেও এখন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। আর সেই প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে ঋণ পরিশোধ করা হবে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে ব্রিটেনকে নজির হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মহামারির আগে দেশটির ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৮০ শতাংশ, গত আড়াই বছরে তা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে ১০০ শতাংশে উঠেছে। সদ্য পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস যার ধাক্কা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তিনি ও তাঁর সাবেক অর্থমন্ত্রী কোয়াজি কোয়ার্টাঙ কর হার কমিয়ে প্রবৃদ্ধির পালে হাওয়া দিতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া আসন্ন শীতে জ্বালানির উচ্চ ব্যয়ের হাত থেকে পরিবার ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রেহাই দিতে বড় ধরনের ছাড়ও দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু এ বিপুল কর হ্রাসের কারণে সরকারের প্রতিশ্রুত খরচের জোগান আসবে কোত্থেকে, সেই প্রশ্নে ব্রিটেনের আর্থিক বাজারে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। তাতে একদিকে পাউন্ডের দাম কমতে থাকে, অন্যদিকে সরকার ঋণ নিতে গেলে সেই ঋণের সুদের হার বাড়তে থাকে। অর্থ সংগ্রহে যুক্তরাজ্য সরকার বন্ড বিক্রি করতে শুরু করে। পেনশনের বাজারেও দেখা দেয় বড় ধরনের সমস্যা। এই পরিস্থিতিতে বন্ড বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডকে বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ড ব্যয় করতে হয়। বাজারের আস্থা ফিরে পেতে ট্রাস অর্থমন্ত্রী কোয়াজি কোয়ার্টাঙকে পদত্যাগ করতে বলেন। কিন্তু বিশ্লেষকেরা একে স্বাভাবিক মনে করেননি।
প্রতিক্রিয়া হয় যুক্তরাজ্যের বাইরেও। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ট্রাসের করছাড়ের নীতি বাতিলের আহ্বান জানায়। শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-সেভেনের সদস্য কোনো দেশকে এভাবে আইএমএফের সুপারিশ জানানো মোটেও স্বাভাবিক কিছু নয়। মিত্রদেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও রাখঢাক না করে প্রধানমন্ত্রী ট্রাসের নীতিকে ভুল বলে আখ্যায়িত করেন।
প্রাথমিকভাবে কোয়াজি কোয়ার্টাঙকে বরখাস্ত করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করেন ট্রাস। নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর জেরেমি হান্ট বাজারের সঙ্গে আপসের পথে হাঁটেন। দায়িত্ব নিয়ে তিনি কোয়ার্টাঙের সংক্ষিপ্ত বাজেট বাতিল করে দেন। পাশাপাশি কর হ্রাস প্রস্তাবের বড় অংশই স্থগিত করেন এবং ঋণসীমার মধ্যে রাখতে ব্যয় হ্রাসের প্রস্তাব দেন। এতে সরকারি ঋণের সুদহার কমে আসে এবং পাউন্ডও শক্তিশালী হয়।
বাস্তবতা হলো, কনজারভেটিভ পার্টি নীতিগতভাবে রক্ষণশীল হলেও পরিস্থিতির চাপে অনেক জনমুখী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের এই জনমুখী নীতি বাস্তবায়নে বাদ সাধে। আর তাতেই পদত্যাগ করতে হয় লিজ ট্রাসকে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাজার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে জনমুখী রাজনীতির পরাজয় লিজ ট্রাসের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে।