আইএমএফের নতুন ঋণ কর্মসূচি, এবার ৭ বিলিয়ন ডলার পাচ্ছে পাকিস্তান

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) পাকিস্তানের সঙ্গে একটি নতুন ঋণ কর্মসূচি নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছে। এ কর্মসূচির আওতায় দেশটি ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি ডলার ঋণ পাবে। পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনীতি চাঙা করতে আইএমএফ এ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ঋণের অর্থের বিনিময়ে ইসলামাবাদ আরও এক দফা সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। এসব কমূর্সচির একটি লক্ষ্য হবে দেশটির করজাল আরও বিস্তৃত করা। তবে আইএমএফের শর্ত মেনে পাকিস্তান যেসব সংস্কার কর্মসূচি এর আগে বাস্তবায়ন করেছে, সেগুলো অজনপ্রিয় ছিল।

গত বছর পাকিস্তান যখন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছিল, তখন দেশটি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। এর পাশাপাশি ছিল ২০২২ সালের মারাত্মক বন্যার জের, বিশ্বজুড়ে চলা অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা ও দশকের পর দশক ধরে চলা অব্যবস্থাপনা। এসব কারণে দেশটির অর্থনীতি চরম দুরবস্থায় পড়ে।

একেবারে শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়। বন্ধু কিছু দেশের ঋণ ও আইএমএফের সহায়তার ফলে দেশটির অর্থনীতি রক্ষা পায়। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বিপুল সরকারি ঋণের কারণে পাকিস্তানের অর্থনীতি এখনো প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে।

আইএমএফের কাছ থেকে পাকিস্তান ঋণ পাবে তিন বছর মেয়াদি একটি কর্মসূচির আওতায়। সংস্থাটি এক বিবৃতিতে বলেছে, আইএমএফ নির্বাহী বোর্ডে এই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদিত হতে হবে। এ কর্মসূচি পাকিস্তানের ‘সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা জোরদার এবং শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রাণবন্ত প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবে’।

পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাবে

কয়েক মাস ধরে নতুন এ ঋণের বিষয়ে ইসলামাবাদে কর্মকর্তারা আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ঋণটি পেলে এটি হবে ছয় দশকে আইএমএফের কাছ থেকে পাকিস্তানের পাওয়া ২৪তম ঋণ কর্মসূচি।

তবে এ কর্মসূচির সঙ্গে বেশ কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হলো রাজস্ব বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়া। পাকিস্তানের জনসংখ্যা ২৪ কোটির বেশি এবং দেশটির বেশির ভাগ কাজই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। গত ২০২২ সালে দেশটির মাত্র ৫২ লাখ মানুষ আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছিলেন।

চলতি জুলাই মাসে শুরু হওয়া অর্থবছরে সরকার ৪৬ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ রাজস্ব হিসেবে আদায়ের পরিকল্পনা করছে। গত বছরের তুলনায় এ লক্ষ্যমাত্রা ৪০ শতাংশ বেশি।

রাজস্ব বাড়াতে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ এখন অনেকটা মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে কারণে তারা প্রথাবিরোধী পদক্ষেপও নিচ্ছে। যেমন আয়কর রিটার্ন দেয়নি এমন ব্যক্তিদের ২ লাখ ১০ হাজার সিম কার্ড বন্ধ করে দিয়েছে তারা। এর উদ্দেশ্য হলো, আয়কর রিটার্ন দাখিলে মানুষকে বাধ্য করা।

আইএমএফের আরেকটি দাবি হলো রাজস্ব ঘাটতির হার কমিয়ে আনা। আগামী বছরে ঘাটতি ১ দশমিক ৫ শতাংশ কমিয়ে তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ৯ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সরকারি ঋণের পরিমাণ এখন ২৪২ বিলিয়ন বা ২৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফ বলছে, ২০২৪ সালে সরকারি আয়ের অর্ধেকই খরচ হবে এ ঋণ পরিশোধে।

বিশ্লেষকেরা অবশ্য সরকারের পদক্ষেপগুলোকে ‘ভাসা–ভাসা সংস্কার’ হিসেবে সমালোচনা করেছেন। মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে এসব কর্মসূচি শুধু আইএমএফকে খুশি করতে হাতে নেওয়া হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ।

লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেসের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলী হাসানাইন বলেন, আইএমএফের সঙ্গে যে সমঝোতা হয়েছে, তাতে সেই পুরোনো ধারাই দেখা যাচ্ছে। পাঁচ বছর আগেও আইএমএফ এ ধরনের ঋণ দিয়েছিল। কিন্তু মৌলিক সংস্কারের যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, কর্তৃপক্ষ কি সেটা গ্রহণ করবে?

জনরোষের ভয়

ভোট কারচুপির অভিযোগ মাথায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শাজবাজ শরিফ গত ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে জেলে আটকে রাখা হয়েছে, তিনি নির্বাচনও করতে পারেননি। শাজবাজ শরিফের জোট সরকার দুর্বল। ফলে কঠোর অর্থনৈতিক পদক্ষেপ সরকারের জনপ্রিয়তা আরও ক্ষুণ্ন করবে।

গত মাসে সরকার যে বাজেট দিয়েছে, তা তৈরি করা হয়েছে আইএমএফের নজরদারির মধ্যে। বাজেটে কর ও বিভিন্ন পরিষেবা বিল বাড়ানো হয়েছে। তবে মানুষ এ নিয়ে ক্ষুব্ধ। এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবাদও হয়েছে। আগামী সপ্তাহগুলোতে আরও বিক্ষোভ কর্মসূচির পরিকল্পনা করা হয়েছে।

পাকিস্তানের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। গত এপ্রিল বিশ্বব্যাংক বলেছে, আরও এক কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০২৩ সালে আইএমএফ পাকিস্তানকে তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছিল, যা দেশটির জন্য একটি জীবনদায়ী ব্যবস্থা হিসেব চিহ্নিত হয়েছে।

কিন্তু একই সঙ্গে কৃচ্ছ্রসাধনসহ যেসব শর্ত এ কর্মসূচির আওতায় বাস্তবায়ন করতে হয়েছে, সেগুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। বেশ কিছু ভর্তুকি সরকার এ সময় তুলে নেয়।

সাম্প্রতিক মাসগুলোয় পাকিস্তানের চলতি হিসাবে খানিকটা উন্নতি ঘটেছে ও মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে।

আইএমএফ পূর্বাভাস দিয়েছে, চলতি অর্থবছরে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। তবে গড় মূল্যস্ফীতি ২৫ শতাংশে থাকবে বলে সংস্থাটি মনে করে। ২০২৫ ও ২০২৬ সালে মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমে আসবে বলে আইএমএফ ধারণা করছে।