বিশ্ববাজারে আগামী দুই বছর পণ্যমূল্য কমতে পারে, বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস
করোনা মহামারির অভিঘাতে ২০২১ সাল থেকেই বিশ্বে পণ্যমূল্য বাড়তে শুরু করে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। দেশে দেশে মূল্যস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। এরপর অবশ্য উন্নত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অনেকটা কমেছে।
বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্যও স্থিতিশীল হতে শুরু করেছে। তাতে ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য সার্বিকভাবে ৩ শতাংশ কমেছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী দুই বছরে পণ্যমূল্য কমার এই ধারা অব্যাহত থাকবে। বিশ্ব ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য ৫ শতাংশ এবং ২০২৬ সালে তা আরও ২ শতাংশ কমবে। ফলে পণ্যমূল্য ২০২০ সালের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে আসবে। সব মিলিয়ে ২০২৫ সালে খাদ্যমূল্য ৯ শতাংশ এবং জ্বালানির দাম ৬ শতাংশ কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের কমোডিটি মার্কেটস আউটলুক শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে বিশ্বজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধাক্কা অনেকটাই প্রশমিত হয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা স্থিতিশীল হয়েছে। যেসব কারণে পণ্যমূল্য বাড়ছিল, সেগুলো অনেকটাই দূর হয়েছে, যেমন চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা। যদিও এই সময় ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা বেড়েছে, বাণিজ্য বাধা এসেছে, আবহাওয়াজনিত সরবরাহ–সংকট হয়েছে। তা সত্ত্বেও পণ্যের দাম কমেছে।
প্রতিবেদনে জ্বালানির বিষয়ে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে স্বল্প মেয়াদে এই পণ্যের দাম বাড়তে পারে। চলতি বছরের এপ্রিল এবং ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৯০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। যার কারণ ছিল ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা। তবে চাহিদা কমে যাওয়ায় পরে দাম কমেছে। সেই সঙ্গে বৈশ্বিক জিডিপিতে তেলের যে ভূমিকা ছিল, তার অনুপাতও কমে আসছে। ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুড তেলের গড় দাম ছিল ৮০ ডলার। বিশ্বব্যাংকের ধারণা, আগামী বছর অপরিশোধিত তেলের গড় দাম ব্যারেলপ্রতি ৭৩ ডলার এবং ২০২৬ সালে ৭২ ডলারে নেমে আসবে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ ও ২০২৬ সালে বৈশ্বিক জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও স্থিতিশীল থাকবে; অর্থাৎ জিডিপির এমন কোনো প্রবৃদ্ধি হবে না, যা হঠাৎ করে পণ্যের চাহিদা বাড়িয়ে দেবে এবং তাতে দামও বেড়ে যাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রবৃদ্ধির হার প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হতে পারে। তাতে সেখানে পণ্যের চাহিদা বাড়তে পারে। এদিকে চীন সরকার অর্থনীতি চাঙা করতে প্রণোদনা আরও বৃদ্ধি করলে শিল্পপণ্যের দাম বাড়তে পারে। চীনের প্রবৃদ্ধির হার বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য হ্রাস-বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত যে প্রান্তিকে চীনের প্রবৃদ্ধির হার কমেছে, তখন দেশটিতে পণ্যের দামও কমে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যহ্রাসের কারণে সামগ্রিকভাবে বিশ্ব মূল্যস্ফীতির হারও আগামী বছর কমবে। পণ্যমূল্য ও মূল্যস্ফীতি কমলে বিভিন্ন দেশের নীতি সুদহারও লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ইন্দরমিত গিল বলেছেন, পণ্যমূল্য হ্রাস এবং পর্যাপ্ত সরবরাহব্যবস্থা ভূরাজনৈতিক সংঘাত সমাধানে ভূমিকা রাখতে পারে। উচ্চ মূল্য, সংঘাত, প্রতিকূল আবহাওয়াসহ অন্যান্য জটিলতা চলতি বছর ৭২ কোটি ৫০ লাখের বেশি মানুষকে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিনিয়োগকারীদের কাছে জনপ্রিয় পণ্য স্বর্ণ। চলতি বছর স্বর্ণের গড়মূল্য রেকর্ড পরিমাণ বাড়বে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। মূল্যবান ধাতুটির দাম চলতি বছর ২১ শতাংশ বেড়েছে। আগামী বছরও মূল্যবৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাতে দাম রেকর্ড পর্যায়ে উঠবে। তবে প্রতিবেদনটি ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার আগেই প্রকাশিত হয়েছে। ট্রাম্প যেভাবে বিটকয়েনসহ ক্রিপ্টোকারেন্সির পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, তাতে ইতিমধ্যে সোনার দাম কিছুটা কমেছে। বিটকয়েনের দাম বাড়তে থাকলে সোনার দাম কমবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ, তখন মানুষ বিনিয়োগ মাধ্যম হিসেবে বিটকয়েনের দিকে ঝুঁকবে।
সবকিছু নির্ভর করছে বৈশ্বিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর। পণ্য সরবরাহ ব্যাহত না হলে ও বাণিজ্য বাধা বৃদ্ধি না পেলে পণ্যের মূল্যহ্রাসের ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই ধারণা করছে বিশ্বব্যাংক। ট্রাম্প রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে শুল্ক বৃদ্ধির কথাও বলেছেন। ফলে বাজারে মিশ্র পরিবেশ বিরাজ করবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।