ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধের দামামা, তেলের দামের সাপ্তাহিক বৃদ্ধি এক বছরে সর্বোচ্চ
বিশ্ববাজারে আবার অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামার মধ্যে সপ্তাহের ভিত্তিতে তেলের দাম যতটা বেড়েছে, তা গত এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। তেলের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এক বক্তব্যের পর বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে এসেছে।
রয়টার্স জানিয়েছে, শুক্রবার ব্রেন্ট ধরনের অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৪৩ সেন্ট বেড়ে ৭৮ দশমিক ০৫ ডলারে দাঁড়ায়। বৈশ্বিক তেলের বাজারে আরেক বেঞ্চমার্ক হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের দাম বাড়ে প্রতি ব্যারেলে ৬৭ সেন্ট। দিন শেষে এই তেলের দাম দাঁড়ায় ৭৪ দশমিক ৩৮ ডলার।
ইরান মঙ্গলবার ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর তেহরানের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালানোর ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। এক সপ্তাহ আগে তেহরান–সমর্থিত হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর নেতা হাসান নাসরুল্লাহর হত্যার পর ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। তেলের বাজার বিশেষজ্ঞরা এর পর থেকে ক্রেতাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে এই সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়লে তা বিশ্বে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।
শুক্রবারে এক পর্যায়ে তেলের দাম ২ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইরানের তেল অবকাঠামো লক্ষ্য করে সম্ভাব্য ইসরায়েলি হামলা নিরুৎসাহিত করার পর তেলের দাম খানিকটা কমে আসে। বাইডেন বলেন, তিনি যদি ইসরায়েলিদের অবস্থানে থাকতেন, তাহলে তিনি ইরানের তেলক্ষেত্র আক্রমণ না করে বিকল্প কিছু ভাবতেন।
বৃহস্পতিবার বিশ্ববাজারে তেলের দাম নির্ধারক বেঞ্চমার্কগুলো ৫ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়। বাইডেন ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করছেন, এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তেলের দামে উল্লম্ফন ঘটে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তখন নিশ্চিত করেছিলেন যে ইরানের তেল অবকাঠামোর ওপর ইসরায়েলি হামলাকে তিনি সমর্থন জানাবেন কি না, তা নিয়েই তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করছেন।
সপ্তাহের ভিত্তিতে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম বেড়েছে ৮ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালের জানুয়ারির পর এই তেলের দাম এতটা বাড়েনি। অন্যদিকে এ সপ্তাহে ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা ২০২৩ সালের মার্চের পর সবচেয়ে বেশি।
জেপি মর্গানের কমোডিটি বিশ্লেষকেরা এক নোটে লিখেছেন, ইরানের তেল অবকাঠামোতে হামলা ইসরায়েলের পছন্দের বিষয় হবে না। তারপরও বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে যাবে, কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যথেষ্ট পরিমাণ তেল মজুত করে রাখেনি। যত দিন না এই সংঘাতের অবসান না ঘটছে, তত দিন দাম বাড়তে থাকবে বলেই সম্ভাবনা রয়েছে।
জাহাজ চলাচলসংক্রান্ত তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কেপলারের সূত্রে জেপি মর্গানের কমোডিটি বিশ্লেষকেরা আরও বলেন, গত বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ তেলের মজুত ছিল, এখন মজুত তার চেয়ে কম। গত বছর এই সময়ে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ছিল ৯২ ডলার। দেশে দেশে মজুত তেলের পরিমাণ ৪৪০ কোটি ব্যারেল, যা সর্বনিম্ন মজুতের একটি রেকর্ড।
তেলের বাজারে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান স্টোনএক্স পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, ইরানের তেল অবকাঠামোতে আঘাত হানা হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম ৩ থেকে ৫ ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর শুক্রবার ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে আসেন। তখন তিনি ইসরায়েলবিরোধী আরও সংগ্রামের ডাক দেন। ইরানের আধা সরকারি এসএনএন বার্তা সংস্থা বিপ্লবী গার্ডের উপ–অধিনায়ক আলী ফাদাবিকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ইরানের তেল অবকাঠামোতে আক্রমণ চালানো হলে তেহরান ইসরায়েলের জ্বালানি ও গ্যাস অবকাঠামোতে হামলা চালাবে।
ইরান ওপেক প্লাসের সদস্য। দেশটি প্রতিদিন ৩২ লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করে, যা বিশ্বে উৎপাদিত তেলের ৩ শতাংশ। ইরানি তেলের সরবরাহ ব্যাহত হলে ওপেক গোষ্ঠীর বাকি সদস্যরা তাদের অব্যবহৃত সক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়িয়ে ঘাটতি পূরণ করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তেলের দাম খুব বেশি বাড়বে না বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাইস্টাডের বিশ্লেষকেরা।
লিবিয়ায়ও তেলের সরবরাহ নিয়ে শঙ্কা কিছুটা কেটেছে। দেশটির পূর্বাঞ্চলভিত্তিক সরকার ও ত্রিপোলিতে অবস্থিত ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশন বৃহস্পতিবার জানিয়েছে, সব তেলক্ষেত্রে ও রপ্তানি অবকাঠামো পুরোদমে চালু করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে কে থাকবেন, এ নিয়ে তেলের উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যাহত হয়েছিল।