পরিবর্তন হচ্ছে মোহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি আরবের
গাজায় যে হামলা চলছে, তা মধ্যপ্রাচ্যের সেই পুরোনো ইমেজকে ফিরিয়ে এনেছে—সংঘাত, যুদ্ধ, রক্তপাত। তবে মধ্যপ্রাচ্যের সব জায়গায় অবশ্য চিত্র একই রকম নয়।
বিনিয়োগবিষয়ক ম্যাগাজিন ব্যারনসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একসময় সৌদি আরবের পরিচিতি ছিল ওই অঞ্চলের সবচেয়ে রক্ষণশীল দেশ হিসেবে। কিন্তু বিশ্বের যেসব সমাজ বর্তমানে খুব দ্রুত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সৌদি আরব তার একটি। একই সঙ্গে দেশটির রয়েছে অর্থনৈতিক উচ্চাশা। এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানানসই একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দেশটি।
সৌদি আরবের শাসনকর্তা হিসেবে একজন বাদশাহ থাকলেও আসল ক্ষমতা যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের হাতে। তাঁর অধীন দেশটিতে নারী কর্মসংস্থান দ্বিগুণ হয়েছে। যে শিল্প বিনোদন ও ছুটি কাটানোর সব ব্যবস্থা ও অবকাঠামো নিশ্চিত করে, তার অস্তিত্বই ছিল না সৌদি আরবে। এখন সেই শিল্প জমজমাট কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে দেশটিতে।
আঞ্চলিক শেয়ারবাজারগুলোর তুলনায় সৌদি আরবের শেয়ারবাজার বলা যায় টিমটিম করেই জ্বলছিল। কিন্তু ২০২২ সালের পর থেকে এই বাজারে ৭০টি কোম্পানি গণপ্রস্তাব নিয়ে এসেছে। দুবাইভিত্তিক ইস্ট ক্যাপিটালের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক এমের অ্যাকাকম্যাক মনে করেন, গত ১০ বছরে সৌদি শেয়ারবাজার ৫০ বছরের অগ্রগতি অর্জন করেছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানকে সবাই চেনেন এমবিএস হিসেবে। মনে হচ্ছে, মাত্র ৩৮ বছর বয়সী এই রাজপুত্র ভূরাজনীতির খেলায় বেশ সাবালকত্ব অর্জন করেছেন। ছয় বছর আগে ভিন্নমতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগি খুন হয়েছিলেন। সেই হত্যাকাণ্ডে তাঁর হাত ছিল—এমন অভিযোগ গণমাধ্যমে হেডলাইন হয়েছে। কিন্তু সেই ঘটনা পেছনে ফেলে এমবিএস অনেকটাই সামনে এগিয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
রিয়াদ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও বেশি প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় জড়িত রয়েছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গেও রয়েছে তার সখ্য। সৌদি তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এখন চীন। আবার একই সঙ্গে আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে সৌদি আরব।
বিনিয়োগ ব্যাংক জে পি মরগানের ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান বাজারবিষয়ক কৌশলবিদ ডেভিড অ্যাসেরকফ মনে করেন, সতর্ক বিনিয়োগকারীরা সৌদি আরবের এই ইতিবাচক পরিস্থিতি থেকে লাভবান হতে পারেন। তিনি বলেন, দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে, বিনিয়োগকারীরা সাধারণত এমন কোম্পানি খোঁজেন। সৌদি আরবে সেগুলো পাওয়া যায়।
সৌদি আরবের নিওম প্রকল্প নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। এই প্রকল্পের খরচ ৫০ হাজার কোটি ডলার থেকে বেড়ে দেড় লাখ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। কথা ছিল, ভবিষ্যতের আবাসিক শহর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দ্য লাইন নির্মিত হবে ১০৫ মাইলব্যাপী। তবে এর কলেবর এখন কমিয়ে দুই মাইল করা হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে সৌদি সমাজে। এই সমাজে মানুষের গড় বয়স ৩১, অর্থাৎ সৌদি সমাজ এখন বেশ তরুণ। এই তরুণ সৌদি সমাজ এমবিএসের আনা সব পরিবর্তন বেশ উপভোগ করছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে, সৌদি আরবের তেলবহির্ভূত অর্থনীতি চলতি দশকে ৪ শতাংশ হারে বাড়বে। শরীরচর্চা-বিষয়ক কোম্পানি লিজাম স্পোর্টসের শেয়ারের দাম গত ১৮ মাসে ৮৫ শতাংশ বেড়েছে। সরকারের ডিজিটাল কর্মকাণ্ড-বিষয়ক ঠিকাদারি পাওয়ার পর তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক কোম্পানি এলম কোর শেয়ারের দাম দ্বিগুণ হয়েছে।
ইস্ট ক্যাপিটালের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক এমের অ্যাকাকম্যাক জানান, পর্যটনভিত্তিক যেসব কোম্পানি রয়েছে, যেমন বাজেট সৌদি অ্যারাবিয়া কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেমন আতা এডুকেশনাল—এগুলো হয়ে উঠেছে নতুন সৌদি অর্থনীতির বড় খেলোয়াড়।
সৌদি আরবে দ্রুতই বন্ড বাজারও গড়ে উঠছে। দেশটির ৩০ বছর মেয়াদি সৌদি পেপার বন্ডে একই ধরনের মার্কিন বন্ডের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি সুদ পাওয়া যাচ্ছে। দেশটির সরকারের ঋণ এখনো জিডিপির ৩০ শতাংশের কম। আর রিজার্ভের পরিমাণ ৪৪ হাজার কোটি ডলার।
তবে এমবিএসের সৌদি আরবকে কেউই পুরোপুরি স্থিতিশীল বলে বর্ণনা করবেন না। তিনি যেভাবে দেশকে আধুনিক করতে চাইছেন, তাতে হিতে বিপরীত ঘটতে পারে। ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের উপসাগরীয় ও জ্বালানিবিষয়ক পরিচালক সাইমন হেনডারসন বলেন, ‘আমাকে খুব ভালো একটি সূত্র বলেছে, সৌদি আরবে ৩৫ বছরের কম বয়সীরা এমবিএসকে ভালোবাসে, আর ৩৫ বছরের বেশি যাঁদের বয়স, তাঁরা তাঁকে রীতিমতো ঘৃণা করেন।’
সৌদি আরবের জন্য ইরান এখনো একটি হুমকি। তেহরান পারমাণবিক অস্ত্র পাওয়ার দৌড়ে খানিকটা এগিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরও বেশি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা পেতে হলে সম্ভবত ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিতে হবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এমবিএসের পক্ষে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
কিন্তু এক দশক আগের কেউ যদি সময় পরিভ্রমণ করে সৌদি আরবে বর্তমান অবস্থা দেখেন, তাহলে তিনি দেশটির পরিবর্তন দেখে রীতিমতো চমৎকৃত হবেন। সাইমন হেনডারসন যেমনটা বলছেন, সাফল্যের যে সংজ্ঞা আছে, মোটাদাগে এমবিএস তার মধ্যে পড়বেন। তবে তাঁর জন্য এখনো অনেক ‘কিন্তু’ রয়ে গেছে।