পশ্চিমা বিশ্বে দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হচ্ছে আজ থেকে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সুইজারল্যান্ডের বৃহৎ ব্যাংক ক্রেডিট সুইসকে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অর্থাৎ টিকে থাকতে বড় কিছু করতে হবে, তা না হলে ভেঙেও পড়তে পারে তারা।
পশ্চিমা ব্যাংক খাতে অস্থিরতা বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের তিন দিনের ব্যবধানে দুটি ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পর গত সপ্তাহে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক ক্রেডিট সুইস তারল্য বাড়াতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ঋণ নেয়। সেই রেশ কাটতে না কাটতে এবার জানা গেল, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রেডিট সুইসকে ইউবিএস এজির সঙ্গে একীভূত হতে পরামর্শ দিয়েছে। খবর রয়টার্সের।
এদিকে বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ পাওয়ার খবরে ক্রেডিট সুইসের শেয়ারদর বাড়লেও শুক্রবার আবার কমেছে। সামগ্রিকভাবে ব্যাংকের শেয়ারদর পতন অব্যাহত আছে।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রেডিট সুইস ও ইউবিএসকে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দিলেও তারা এ ব্যাপারে নিমরাজি। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে এমন ক্ষমতা নেই, যাতে তারা ব্যাংক দুটিকে একীভূত হতে বাধ্য করতে পারে। ব্যাংক দুটির পরিচালনা পর্ষদ এ সপ্তাহে পৃথক বৈঠক করবে বলেও জানা গেছে।
ক্রেডিট সুইসের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা দীক্ষিত যোশী এ সপ্তাহে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করে ব্যাংকের কৌশলগত অবস্থান ঠিক করবেন।
রয়টার্স জানিয়েছে, এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা দেশের অন্তত চারটি ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের সঙ্গে লেনদেনের বিষয়ে সীমাবদ্ধতা জারি করেছে, যেমন সোসিয়েত জেনারেল এসএ ও ডয়েচে ব্যাংক।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক দলের বেশ কয়েকজন সাংসদ এসভিবির পতনে পেছনে বৃহৎ বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের হাত আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও বিচার বিভাগকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
তিন দিনের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধের পর যে আশঙ্কা ছড়িয়েছিল, তা আরও ঘনীভূত হয় বুধবার সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার খবরে। বৃহস্পতিবার জানা গেল, আর্থিক সংকটে আছে আমেরিকারই ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কড়া নজরদারিতে ছিল তারা। তবে সান ফ্রান্সিসকোভিত্তিক এ ব্যাংকের পতন ঠেকাতে এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্যাংক। জে পি মরগ্যান ও সিটি গ্রুপের নেতৃত্বে ১১টি ব্যাংক ফার্স্ট রিপাবলিককে ৩০ বিলিয়ন বা ৩ হাজার কোটি ডলার আমানত দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, উচ্চ নীতি সুদের জমানায় ব্যাংকিং শিল্পের একাংশ আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে, তা স্পষ্ট। ফলে অনেক বিশ্লেষক যা–ই বলুন না কেন, এই পরিস্থিতি ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দার স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে, যখন বিশ্বজুড়ে একের পর এক ব্যাংক দেউলিয়া হয়েছিল।
শেয়ারের দরপতন চলছে
এদিকে বৃহস্পতিবার ক্রেডিট সুইসের শেয়ারদর বাড়লেও শুক্রবার আবারও তাদের শেয়ারদর পড়েছে ৮ শতাংশ। ১৩ থেকে ১৫ মার্চ ব্যাংকটি থেকে ৪৫ কোটি ডলার আমানত তুলে নিয়েছেন আমানতকারীরা।
একই সঙ্গে শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোর রক্তক্ষরণ অব্যাহত ছিল। সেদিন তাদের এসঅ্যান্ডপি ব্যাংক ইনডেক্সের পতন হয়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। গত দুই সপ্তাহে এই সূচকের পতন হয়েছে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনাভাইরাসজনিত লকডাউনের পর তাদের শেয়ারদর আর কখনো এতটা পড়েনি।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ১১টি ব্যাংকের কাছ থেকে কলমানি পাওয়া ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের। শুক্রবার তাদের শেয়ারদর কমেছে ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ। এতে গত ১০ অধিবেশনে তাদের শেয়ারদর কমেছে ৮০ শতাংশের বেশি।
কেন বন্ধ হলো দুটি ব্যাংক
গত বছরের শুরুতেই ফেডের নীতি সুদহার ছিল শূন্যের কাছাকাছি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবিলায় গত এক বছরে ফেড আটবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। এতে বাণিজ্যিক ঋণ ও বন্ডের সুদহার বেড়েছে। ঋণ ও বন্ডের সুদহার বৃদ্ধির সম্মিলিত ফলাফল হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি এড়িয়ে নিরাপদ জায়গায় বিনিয়োগের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়া। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীরা ভাবছেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্যিক প্রকল্পে বিনিয়োগ না করে বরং বন্ডে বিনিয়োগ করাই ভালো, আরামে সুদ খাওয়া যাবে।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সিলিকন ভ্যালির স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো। স্টার্টআপগুলো সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে রাখা আমানত ভাঙতে শুরু করেছে। ফলে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের আমানতে টান পড়েছে। এ বাস্তবতায় এসভিবি গত বুধবার ২১ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১০০ কোটি ডলারের বন্ড বিক্রি করে, যার সিংহভাগই ছিল ট্রেজারি বন্ড। এর সুদহার ছিল ১ দশমিক ৯, অথচ ১০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার প্রায় ৩ দশমিক ৯। এ কারণে বন্ড বিক্রি মুখ থুবড়ে পড়ে। এতে তাদের ক্ষতি হয় ১৮০ কোটি ডলার।
এরপর সেই ক্ষতি পোষাতে ৯ মার্চ এসভিবি ২২৫ কোটি ডলার সমমূল্যের ইকুইটি বিক্রির ঘোষণা দেয়। বলা যায়, এটা ছিল কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার মতো। তখন হুড়মুড়িয়ে আমানত তুলে নিতে শুরু করেন আমানতকারীরা। পতন ঘটে ৪০ বছরের পুরোনো এই ব্যাংকের। তার জেরে তিন দিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় সিগনেচার ব্যাংক।