নতুন বছরে কী হতে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে
স্বাগত ২০২৫। নতুন বছরে বিশ্ব অর্থনীতি ও বাণিজ্যে কী ঘটতে পারে, তা নিয়ে সবারও কৌতূহল থাকা স্বাভাবিক। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে কি না, তা নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনা আছে।
কথা হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প পূর্ণাঙ্গ শুল্কযুদ্ধ করবেন কি না। ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের (এফটি) এক সংবাদে বলা হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ শুল্কযুদ্ধের সম্ভাবনা আছে, কিন্তু বিষয়টি শতভাগ নিশ্চিত নয়। শুল্কযুদ্ধ বলতে এফটি বুঝিয়েছে, বছরের শেষ নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি করা সব পণ্যে অন্তত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। চীন ছাড়া কানাডা ও মেক্সিকোর পণ্যে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। এই দুই দেশ থেকে মোট আমদানির ৩০ শতাংশ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। তারাও নানাভাবে ট্রাম্পের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে।
কিন্তু অতিরিক্ত শুল্ক প্রাপ্তির কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প এই শুল্ক লড়াই চালিয়ে যাবেন বলে ধারণা করছে এফটি। ফলে বছরের শেষ নাগাদ এসব শুল্ক প্রত্যাহার করা হবে, এমনটা মনে করেন না ট্রাম্প।
এরপর সবচেয়ে গুরুতর উদ্বেগের জায়গা হলো ফেডারেল রিজার্ভের নীতি সুদহার নিয়ে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের পর একাধিকবার নীতি সুদহার কমানো হয়েছে। ফলে কথা হচ্ছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের নীতি সুদহার কি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের নীতি সুদহারের চেয়ে কমবে। এফটি মনে করছে, সেটা হওয়ার কথা নয়।
বাস্তবতা হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্কবৃদ্ধি, করপোরেট করহার হ্রাসসহ যেসব নির্বাচনী অঙ্গীকার করেছেন, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে। ফেড এই বিষয়ে সতর্ক থাকবে বলে এফটির সংবাদে বলা হয়েছে, যদিও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার হ্রাসের ধারা অব্যাহত রাখবে বলে ধারণা।
২০২৪ সালের শেষভাগে বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো বিটকয়েনের মূল্যবৃদ্ধি। বিশেষ করে ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর বিটকয়েনের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। এই বাস্তবতায় বিটকয়েনের দাম দুই লাখ ডলারে উঠে যেতে পারে বলে ধারণা।
কেন নয়, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে ক্রিপ্টো মুদ্রার রাজধানী করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর নিয়োগ দেওয়া সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান ক্রিপ্টো মুদ্রার লেনদেন আরও সহজ করবেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে বিটকয়েন ধরে রাখা ও এই মুদ্রায় লেনদেন করা আরও সহজ হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা পেলে এই মুদ্রার দাম দুই লাখ ডলারে উঠে যেতে পারেই বলে মনে করছে এফটি।
বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশ ভারত। ২০২৫ সালে এই দেশের জিডিপি জাপানকে ছাড়িয়ে যাবে, এমন পূর্বাভাস ছিল। কিন্তু এফটি বলছে, সম্প্রতি দুই প্রান্তিকে ভারতের প্রবৃদ্ধির গতি কমে যাওয়ায় ২০২৫ সালে নয়, বরং ২০২৬ সালে ভারতের জিডিপি জাপানকে ছাড়িয়ে যাবে। মুদ্রার বিনিময় হারের প্রভাব পড়তে পারে এ ক্ষেত্রে। কিন্তু ইয়েন ইতিমধ্যে দুর্বল হলেও রুপি শক্তিশালী, এই বাস্তবতায় পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
গত কয়েক বছরে বিশ্ববাজারে বৈদ্যুতিক গাড়ি বিক্রি অনেকটাই বেড়েছে। পূর্বাভাস ছিল, ২০২৫ সালে বিশ্বে মোট যত গাড়ি বিক্রি হবে, তার ২৫ শতাংশ হবে বৈদ্যুতিক গাড়ি। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, এই সংখ্যাটা হতে পারে ২২ শতাংশের কিছুটা বেশি।
এফটির সংবাদে বলা হয়েছে, চীনের বাইরে অন্যান্য দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা অতটা বৃদ্ধি না পাওয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু পরিবেশগত বাধ্যবাধকতার কারণে ইউরোপের গাড়ি কোম্পানিগুলো নতুন নতুন মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারে আনবে এবং সেগুলো গ্রাহকদের ক্রয়সীমার মধ্যে আনতে আরও শত শত কোটি ডলার ছাড় দেবে। বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারের জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি। ডোনাল্ড ট্রাম্প জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারের পক্ষে, যদিও বৈদ্যুতিক গাড়ির সবচেয়ে বড় কোম্পানি টেসলার কর্ণধার ইলন মাস্ক তাঁর অতি গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী।
নীতি সুদহার বৃদ্ধির জেরে গত কয়েক বছরে বিশ্বের বিনিয়োগকারীরা মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের দিকে ঝুঁকেছেন। কিন্তু ট্রাম্পের ঘোষিত নীতির কারণে সেই বাজারের কী অবস্থা হবে, তা নিয়ে একধরনের শঙ্কা আছে। তবে এফটির সংবাদে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণ বৃদ্ধিসহ, করহার হ্রাসের যে অঙ্গীকার ট্রাম্প নির্বাচনের সময় করেছিলেন, বাজারে তার প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বন্ড থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা উঠে গেলে দেশটির আর্থিক খাত বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে, এমনকি স্টক মার্কেটেও তার প্রভাব পড়তে পারে। সে কারণে ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্প এমন কিছু করবেন না, যার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ডের বাজার থেকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা উঠে যাবে।
নতুন বছরে চীনের রপ্তানি পণ্যের মূল্য আরও কমতে পারে বলে মনে করছে এফটি। চীনের অধিক উৎপাদনসক্ষমতা ও কোম্পানির প্রতিযোগিতার কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বলে সংবাদে বলা হয়েছে। ২০২৪ সালের অক্টোবরে চীনের রপ্তানির মূল্য সূচক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ২ শতাংশ কম ছিল। চলতি বছরের একই সময়ে তা ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে বলে ধারণা। এতে চীনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের প্রতিযোগিতা করা আরও কঠিন হয়ে যাবে। মার্কিন পণ্যের পক্ষেও চীনা পণ্য হটানো সম্ভব হবে না।
নতুন বছরে প্রযুক্তি খাতের আরও বাড়বাড়ন্ত হবে বলে মনে করছে এফটি। অ্যালফাবেট, অ্যামাজন, অ্যাপল, মেটা, মাইক্রোসফট, এনভিডিয়া ও টেসলার রাজত্ব চলবে। বিশেষ করে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে গত কয়েক বছরে, তা আরও চলবে। ট্রাম্পের বিজয়ের মধ্য দিয়ে যেটা হয়েছে সেটা হলো, স্থবির রাজনৈতিক চক্রের জায়গা নিয়েছে গতিশীল বেসরকারি খাত, যার নেতৃত্বে আছে প্রযুক্তি খাত। তবে এআই নিয়ে যে অতিরিক্ত উৎসাহ তৈরি হয়েছে, তা কিছুটা থিতিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।