চীনের হুয়াওয়ের নতুন স্মার্টফোন নিয়ে কেন এত হইচই
চীনের হুয়াওয়ের নতুন কিছু স্মার্টফোন বিশ্বের সবার নজর কেড়েছে। আগস্টের শেষে প্রথমে দুটি মডেলের ফোন বাজারে ছাড়ে কোম্পানিটি। এরপর গতকাল শুক্রবার আরও দুটি। এসব ফোনসেট বাজারে আসার পর শুরু হয়েছে হইচই। এমন ইঙ্গিতও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে যে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পরাস্ত করে হুয়াওয়ে প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন করেছে।
আর মাত্র কয়েক দিন পরে অ্যাপলের নতুন ফোন বাজারে আসবে। পশ্চিমা জগতে নানা রকম বিধিনিষেধের মধ্যে পড়ার আগে হুয়াওয়েকে অ্যাপলের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হতো। নতুন স্মার্টফোন বাজারে ছাড়ার মাধ্যমে চীনা কোম্পানিটি আবারও অ্যাপলের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে বলে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
আগস্টে হুয়াওয়ে বাজারে ছাড়ে মেট ৬০ ও মেট ৬০ প্রো মডেলের দুটি ফোন। এরপর শুক্রবারে আসে মেট এক্স ৫ স্মার্টফোন, যেটি ভাঁজ করা যায় এমন মডেলের নতুন সংস্করণ এবং মেট ৬০ প্রো প্লাস। মেট ৬০ ফোনের দাম রাখা হয়েছে ৫ হাজার ৯৯৯ ইউয়ান, যা ৮১৭ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ। চীনে আইফোন ১৪ মডেলের দামও একই।
চীন হলো পৃথিবীতে স্মার্টফোনের সবচেয়ে বড় বাজার। ফলে আলোচনা চলছে, এ ফোনের ফিচার কী, কারা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে ইত্যাদি নিয়ে।
মেট ৬০ সিরিজের ফোন কতটা শক্তিশালী
হুয়াওয়ে তাদের বিজ্ঞাপনে যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছে, তা হলো এটি দিয়ে কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কথা বলা যায়। অর্থাৎ যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই কিংবা ইন্টারনেট নেই—যেমন পাহাড় বা সাগর, এমন জায়গা থেকেও এই ফোনসেট ব্যবহার করে কথা বলা যাবে।
কী ধরনের চিপ এই ফোনে ব্যবহার করা হয়েছে, তা নিয়ে হুয়াওয়ে কিছু বলেনি। কিন্তু বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান টেকইনসাইটস খুঁজে পেয়েছে যে এটিতে নতুন ধরনের কিরিন ৯০০০ চিপ ব্যবহার করা হয়েছে। এই চিপ চীনে তৈরি করেছে সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্টারন্যাশনাল করপ (এসএমআইসি)।
চীনের যেসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হুয়াওয়ের ফোনের গতি নিয়ে পরীক্ষা করেছে, তাতে দেখা গেছে যে মেট ৬০ প্রো সেরা যেকোনো ৫জি ফোনের চেয়েও দ্রুতগতিতে তথ্য ডাউনলোড করতে পারে।
চীনের অনেক ক্রেতা অ্যাপলের সর্বশেষ আইফোন ১৪–এর সঙ্গে হুয়াওয়ের ফোনের তুলনা করে জানিয়েছেন যে স্টোরেজ ও মেমরির দিক দিয়ে এগুলো কাছাকাছি।
মেট ৬০–এর যন্ত্রাংশের সরবরাহকারী
ফোনগুলোর জন্য যন্ত্রাংশ কারা সরবরাহ করেছে, হুয়াওয়ে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি। তবে টেকইনসাইটস এসএমআইসির যন্ত্রাংশ ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়ার এসকে হাইনিক্সের ড্রাম ও ন্যান্ড যন্ত্রাংশ খুঁজে পেয়েছে। তবে এসকে হাইনিক্স বলছে, তারা ২০১৯ সালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর হুয়াওয়ের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। তারা জানিয়েছে যে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
টেকইনসাইটস আরও জানিয়েছে, আগের যেকোনো মডেলের তুলনায় মেট ৬০ প্রো ফোনে অনেক বেশি চীনে তৈরি চিপ যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। চীনা সরবরাহকারী অনেক কোম্পানির নাম অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। দেখা গেছে, এসব কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েই চলেছে।
কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ হুয়াওয়ের বর্তমান সরবরাহকারী। একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম হুয়াওয়ে স্মার্টফোন বাজারে ছাড়ার পর থেকে প্রতিদিন ১০ শতাংশ করে বাড়ছে। আরেকটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ১৫ শতাংশ বেড়েছে। ভিশনক্স টেকনোলজি জানিয়েছে যে তারা মেট ৬০ সিরিজের জন্য যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেছে।
চীনের বাজার
বিক্রির দিক বিবেচনায় নিলে হুয়াওয়ে একসময় ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্মার্টফোন নির্মাতা। কিন্তু আধুনিক স্মার্টফোন তৈরির জন্য যে ধরনের চিপের প্রয়োজন, তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর হুয়াওয়ের বাজার পড়ে যায়। তাদের কাছে মজুত যে চিপ ছিল, তা ব্যবহার করে কোম্পানিটি অল্প কিছু ৫জি মডেলের ফোন তৈরি করতে সমর্থ হয়।
চীনের বাজারেই ২০২০ সালে হুয়াওয়ের বাজার শেয়ার ছিল ২৭ শতাংশ। এ বছরে তা কমে হয়েছে ১১ শতাংশ। টিকে থাকার জন্য কোম্পানিটি তাদের সবচেয়ে সস্তা হ্যানোর মডেলের ফোন বেশি বিক্রি শুরু করে।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে অ্যাপল চীনে সবচেয়ে বড় স্মার্টফোন নির্মাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। এ সময়ে চীনের বাজারে অ্যাপলের অংশীদারত্ব ১১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯ শতাংশ হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্টারপয়েন্টের তথ্যে এমনটি জানা গেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মেট ৬০ নিয়ে সম্ভবত হুয়াওয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ফিরে আসবে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা হুয়াওয়ের নতুন ফোন বাজারে আসার ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি একটি আঘাত হিসেবে দেখাচ্ছে। ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে, ফলে এই জাতীয়তাবাদী চেতনা সেখানে জোরদার হচ্ছে।
টিএফ সিকিউরিটিজের বিশ্লেষক মিংচি কুও বলেন, তিনি আশা করছেন, মেট ৬০ প্রো বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ বিক্রি হবে। আগে যা ধারণা করা হয়েছিল, এই পরিমাণ তার চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি। আর বাজারে ছাড়ার পর সব মিলিয়ে এক বছরে ১ কোটি ২০ লাখ পিস মেট ৬০ প্রো বিক্রি হতে পারে।