দক্ষিণ কোরিয়ায় যে কারণে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কুকুরের মাংসের ব্যবসা
প্রায় ২০ বছর আগে চোই তায়ে–ইয়ন যখন তাঁর রেস্তোরাঁ খুলেছিলেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় তখন কুকুরের মাংসের ব্যবসা জমজমাট ছিল। এখন তিনি ভাবছেন, তাঁকে হয়তো তাঁর রেস্তোরাঁ বন্ধই করে দিতে হবে। একসময় কুকুরের মাংস কোরিয়ায় রুচিকর খাবার হিসেবে বিবেচিত হতো। কিন্তু তার ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
দেগু শহরে চিলসেং বাজারের এক গলিতে চোই তায়ে–ইয়নের রেস্তোরাঁ। এখানে এমন ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয়, একসময় যেগুলোকে মনে করা হতো শারীরিক উদ্যমের জন্য খুবই ভালো। এসব খাবার মূলত তৈরি হয় কুকুরে মাংস ব্যবহার করে—হয় ভাপে রান্না অথবা ঝোলের মধ্যে সেদ্ধ করে।
কোরিয়ার খাবারে একসময় হরদম কুকুরের মাংস ব্যবহার করা হতো। প্রতিবছর সে কারণে কমবেশি ১০ লাখ কুকুরের মৃত্যু ঘটত বলে মনে করেন প্রাণী অধিকারকর্মীরা। তবে গত কয়েক বছরে কুকুরের মাংসের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে কমে গেছে। এর কারণ হলো, তরুণ কোরিয়ানরা এখন কুকুরকে সঙ্গী হিসেবেই বেশি পছন্দ করেন, খাবার হিসেবে নয়।
চোই তায়ে–ইয়ন বার্তা সংস্থা এএফপিকে তাঁর রেস্তোরাঁয় বসে বলছিলেন, ‘খুব নাটকীয়ভাবে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। আগে যখন ব্যবসা ভালো ছিল, দোকানিরা প্রতিদিন ৩০–৪০টি কুকুর বিক্রি করতেন। এখন আমরা খুব বেশি হলে প্রতিদিন এক থেকে দুটি কুকুর বিক্রি করতে পারছি।’
দক্ষিণ কোরিয়ার অল্প বয়সী শহুরে বাসিন্দাদের কাছে কুকুরের মাংস খাওয়া কার্যত একটা ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে। প্রাণী অধিকারকর্মীরা এই প্রথা বেআইনি ঘোষণা করতে সরকারের ওপর চাপ বাড়িয়ে চলছিলেন। শেষ পর্যন্ত দেশটির সংসদ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে।
গত মঙ্গলবার আইনপ্রণেতারা একটি আইন পাস করেছেন। আইনে বলা হয়েছে, মাংসের জন্য কুকুরের লালনপালন, বিক্রি ও জবাই নিষিদ্ধ হবে। অর্থাৎ এই আইনের মাধ্যমে বিতর্কিত এই ব্যবসাকেই কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইউল অনুমোদন দেওয়ার তিন বছর পর এই আইন কার্যকর হবে। প্রেসিডেন্ট নিজেকে একজন প্রাণিপ্রেমী মনে করেন।
আইনভঙ্গকারীকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হবে। অথবা তাঁকে ২৩ হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ৩ কোটি উয়ন (কোরিয়ার মুদ্রা) জরিমানা করা যেতে পারে।
চোই তায়ে–ইয়ন খুব হতাশ যে তাঁকে এই পরিবর্তন মেনে নিতে হচ্ছে। কারণ, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তিনি বলেন, ‘আইনের মাধ্যমে (কুকুরের মাংস বিক্রি) নিষিদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাতে আমি খুশি নই। এখন অর্থ আয় করা আগের চেয়ে সহজ হয়েছে, ফলে প্রাণীর প্রতি মানুষের বেশ ভালোবাসা দেখা যাচ্ছে।’
গত ডিসেম্বরে স্থানীয় গণমাধ্যমে এমন খবর বেরিয়েছে যে শিশুদের বহন করা হয়, এমন স্ট্রলারের তুলনায় ঘরে পালিত পশু বহন করা হয়, এমন বাহনের বিক্রি দেশটির ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো ছাড়িয়ে গেছে। এ খবর দুটি বিষয়ের দিকে নজর ফেরায়। প্রথমত, দক্ষিণ কোরিয়ায় জনসংখ্যাগত সংকট চলছে। দ্বিতীয়ত, লোকজন আরও বেশি করে পশুপাখি পালছেন। পৃথিবীতে যেসব দেশে সবচেয়ে কম শিশু জন্ম নেয়, দক্ষিণ কোরিয়া সেগুলোর একটি।
চোই তায়ে–ইয়ন বলেন, ‘জীবনে সংগ্রাম করতে হয়নি, এমন তরুণেরা কুকুর খুব পছন্দ করেন।’
তবে এই নারীর জন্য তাঁর রেস্তোরাঁটিই জীবন। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি এটি পেয়েছেন। পরিকল্পনা ছিল, ছেলের হাতে তিনি এটি তুলে দেবেন।
অর্থ আয়ের জন্য একসময় চোই তায়ে-ইয়ন অনেক কিছুই করেছেন। ছোটখাটো সাইড ডিশ বিক্রি করেছেন, খাবার বিক্রি করেছেন ফুটপাতেও। বাজারে বাজারে ফেরি করে বিক্রি করেছেন নুডলস। এরপর তিনি থিতু হন তাঁর রেস্তোরাঁয়। যত দিন গেছে, তিনি তাঁর ব্যবসা বাড়িয়েছেন। কারণ, একের পর এক সাফল্য ধরা দিয়েছিল তাঁর কাছে।
এএফপির সংবাদদাতার সঙ্গে যখন চোই তায়ে-ইয়ন কথা বলছিলেন, তখন তাঁর কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, এটা খুবই কষ্টদায়ক যে এভাবে সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে।
দোকানিদের হয়রানি
সাম্প্রতিক সময়ে কুকুরের মাংস বিক্রির বিপক্ষে জনমত বাড়ছিল। চোই তায়ে–ইয়ন বলছিলেন, প্রাণী অধিকারকর্মীরা বাজারের কুকুরের মাংস ব্যবসায়ীদের ক্রমাগতভাবে হয়রানি করে যাচ্ছিলেন। এসব প্রাণী অধিকারকর্মী তাঁদের রেস্তোরাঁর সামনে বিক্ষোভ করেছেন, তাঁদের অভিশাপ দিয়েছেন।
চোই তায়ে–ইয়ন বলেন, ‘খুব কঠোরভাবে এসব করা হয়েছে। আরা যারা বোসিনতাং (কুকুরের মাংসের স্যুপ) বিক্রি করি, তাদের তারা মানুষ হিসেবেই গণ্য করে না।’
বছরের পর বছর ধরে বিক্ষোভের কারণে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে। এই নারী জানালেন, ভবিষ্যতে তিনি শূকরের পাঁজরের স্যুপ বিক্রির চিন্তা করছেন। তবে সেটি তিনি করবেন কুকুরের মাংস বিক্রিসংক্রান্ত আইন কার্যকর হওয়ার পর।
এএফপির প্রতিবেদক যখন বাজারের গলিতে গিয়েছিলেন, তখন তিনি দেখেছেন যে বেশির ভাগ দোকান দৃশ্যত ক্রেতাশূন্য। এসব দোকান একসময় বোসিনতাং বিক্রি করত এবং ক্রেতাদের আগমনে গমগম করত। তবে চোই তায়ে-ইয়ন জানালেন, সাম্প্রতিক সময়ের তুলনায় কুকুরের মাংস নিষিদ্ধ করে আইন পাসের পরদিন বরং তিনি অনেক ক্রেতাকে বাজারে আসতে দেখেছেন।
কুকুরের মাংস বিক্রি করে, এমন আরেকটি রেস্তোরাঁয় বসেছিলেন একজন বয়স্ক ক্রেতা। নিজেকে জ্যাং হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। বলেন, তিনি কুকুরের মাংসের সঙ্গে মদ খেতে পছন্দ করেন। কারণ, এর ফলে পরদিন আর নিজেকে মাতাল মাতাল লাগে না।
এই ব্যক্তি জানান যে খুব ঘন ঘন তিনি কুকুরের মাংস খান না। তবে তিন বছর পর আর এই মাংস খাওয়া যাবে না, এই ভাবনায় তিনি রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছেন। আরেকজন খদ্দের ছিলেন ওই রেস্তোরাঁয়, বয়স ৭০–এর ঘরে। তাঁর কথা হলো, কুকুরের মাংস খেতে না পারলে তাঁর কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তারপরও তিনি আইনটির বিরোধিতা করেন।
এই ব্যক্তির মন্তব্য ছিল এ রকম, ‘মুরগি, শূকর, গরু—সবই জীবন্ত প্রাণী। কিন্তু এই যে কেবলমাত্র কুকুরের মাংস বিক্রি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, আমি সেই বিষয়ের বিরোধিতা করি।’