ট্রাম্পের জমানায় বিনিয়োগের নিরাপদ জায়গা হতে পারে ভারত
ডোনাল্ড ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতির কারণে, বিশেষ করে সুরক্ষাবাদী বাণিজ্যনীতি, বিশ্ববাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। এতে উদীয়মান বাজারগুলোর ঝুঁকি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা। এই পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ভারতকে বিবেচনা করছে। খবর রয়টার্স
গত সপ্তাহে ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয় ও আগামী মাসে হোয়াইট হাউসে তাঁর প্রত্যাবর্তন—এ ঘটনায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। কারণটা সবাই জানেন। নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্পের অঙ্গীকার ছিল চীন থেকে আমদানি করা পণ্যে ৬০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি শুল্ক আরোপ। শুল্ক বাড়ানো হলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি আরও চাপে পড়তে পারে। পরিণামে চীনের বাজার অস্থিতিশীল হবে এবং একই সঙ্গে এশিয়ার অন্যান্য রপ্তানিনির্ভর দেশগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
এই বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যে ভারত তুলনামূলক নিরাপদ বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে উঠে আসছে। রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, ভারতের অর্থনীতি শক্তিশালী অবস্থানে আছে এবং দেশটির প্রবৃদ্ধির হারও তুলনামূলকভাবে ভালো। এ ছাড়া চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তা বাজারের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা কম; এই বাস্তবতা বৈশ্বিক অস্থিরতার প্রভাব থেকে ভারতকে কিছুটা হলেও রক্ষা করতে সক্ষম।
এ ছাড়া ভারতের আর্থিক বাজারে স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের ইকুইটি কেনার চাহিদা আছে প্রবল, ফলে বাজার স্থিতিশীল থাকবে। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও মুদ্রার স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়েছে, ভারতের রুপি অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির মুদ্রার তুলনায় স্থিতিশীল থাকবে।
এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি ভারতের স্টক মার্কেট স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের চাহিদায় পুষ্ট হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো, ভারতীয় কোম্পানিগুলো মূলত অভ্যন্তরীণ বাজারের ওপর নির্ভরশীল, রপ্তানির ওপর নয়। এই বিষয় বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, বাজারের শঙ্কা, ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি আবারও কার্যকর করতে পারেন। ফলে বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধের আশঙ্কা আছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতিতে রপ্তানিনির্ভর এশিয়ার অর্থনীতিগুলোতে গুরুতর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে কোরিয়া ও তাইওয়ান। তারা মনে করে, ভারত তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে আছে, কারণ, ভারতের অর্থনীতি প্রধানত অভ্যন্তরীণ বাজারকেন্দ্রিক ও আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতার প্রভাব সেখানে তুলনামূলকভাবে কম অনুভূত হয়। ট্রাম্পের শুল্কনীতি-উদ্ভূত বৈশ্বিক বাণিজ্য সংঘাতে ভারতের ক্ষতির সম্ভাবনা কম। ফলে ভারত বিনিয়োগকারীদের কাছে স্থিতিশীল গন্তব্য হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে।
তবে চলতি বছর ভারতের শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। অক্টোবরে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা রেকর্ড পরিমাণ ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ১২০ কোটি ডলার তুলে নিয়েছেন। কিন্তু দেশীয় প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা একই সময়ে প্রায় ১২ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২৭০ কোটি ডলার মূল্যের শেয়ার কিনেছেন, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। এই বিনিয়োগের কারণে সূচক বড় ধরনের পতনের হাত থেকে রক্ষা পায়।
ভারতের বিনিয়োগবিষয়ক পরামর্শক ত্রিদীপ ভট্টাচার্যের মতে, দেশি বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো যে সরবরাহব্যবস্থা (সাপ্লাই চেইন) বহুমুখীকরণের চেষ্টা করছে, সে কারণে ভারত উপকৃত হবে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক উৎপাদন, রাসায়নিক ও ওষুধ খাতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলো বাণিজ্য ঝুঁকি ও একক নির্ভরশীলতা কাটাতে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করছে এবং বিকল্প বাজার হিসেবে ভারতের দিকে ঝুঁকছে। ইলেকট্রনিক উৎপাদন খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এবং সরকারের প্রণোদনামূলক প্রকল্পের (প্রোডাকশন লিংকড ইনসেনটিভ বা পিএলআই স্কিম) প্রভাবে এসব খাতে ভারতের সম্ভাবনা আরও বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে দেশি বিনিয়োগকারীরা ভারতের নতুন ও সম্ভাবনাময় খাতগুলোতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন; এই বিনিয়োগ বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও ট্রাম্পের প্রথম জমানার তুলনায় বদলে গেছে। ওই সময় ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির গতি ছিল কম; কিন্তু সাম্প্রতিক ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ।
এদিকে জুরিখভিত্তিক ভন্টোবেল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ভারতের স্টক মার্কেট সম্পর্কে সতর্ক। তবে তারা দেশটির সরকারি বন্ড সম্পর্কে ইতিবাচক এবং বাণিজ্যের মুদ্রা হিসেবে রুপিকেও আকর্ষণীয় মনে করছে।
ভন্টোবেলের ফিক্সড ইনকাম পোর্টফোলিও ম্যানেজার কার্ল ভারমাসেন রয়টার্সকে বলেন, ভারতের সরকারি বন্ড বিনিয়োগ বহুমুখীকরণের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ। সেই সঙ্গে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির স্থিতিশীলতার কারণে রুপিতে বিনিয়োগ করে সুদহারজনিত সুবিধা নেওয়ার সুযোগ আছে।
চলতি বছরের শুরুতে ভারতের সরকারি বন্ডগুলো জে পি মরগ্যানের গ্লোবাল ইমার্জিং মার্কেট ডেট সূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং ২০২৫ সালে এটি আরও দুটি বৈশ্বিক বন্ড সূচকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা আছে।
ভারমাসেন আরও বলেন, রুপির সুবিধা হলো, এটি অন্যান্য উদীয়মান দেশের মুদ্রার মতো নয়, যদিও ডলারের ওঠানামার প্রভাব রুপিতে অনুভূত হয়। এর অর্থ হলো, বিনিয়োগকারীদের জন্য রুপি আকর্ষণীয় সম্পদ হতে পারে।
সম্প্রতি রুপির দরপতন হয়েছে। ৬ নভেম্বর রুপির দর ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়, যদিও সেদিন তার পতন হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। ট্রাম্পের বিজয়ের পর এশিয়া অঞ্চলের অন্যান্য মুদ্রার আরও বেশি দরপতন হয়েছে, কোনো কোনো মুদ্রার দরপতন হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত।