যে পালাবদল ঘটেছে চীনের ঋণে

চীন
রয়টার্স

গত ২২ বছরে চীনের ঋণ দেওয়ার ধরনে বড় পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এইডডেটার তথ্যে জানা যায়, চীনের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ২০০০ থেকে ২০২১ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। তারা বলছে, চীন অবকাঠামো খাতে ঋণ দেওয়া থেকে সরে এসে এখন অর্থনীতি বাঁচাতে, অর্থাৎ বেইল আউট হিসেবে বেশি ঋণ দিচ্ছে। সেই সঙ্গে আফ্রিকার দেশের বদলে ইউরোপীয় দেশগুলোকে এখন বেশি ঋণ দিচ্ছে চীন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ২০১৬ সালে চীন সর্বোচ্চ ঋণ দিয়েছিল, পরিমাণ ছিল ১৩৬ বিলিয়ন বা ১৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। এরপর ২০২১ সালেও তারা ৮০ বিলিয়ন বা ৮ হাজার কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। এইডডেটা বলছে, ১৬৫টি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের ২১ হাজার প্রকল্পে এ অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে।

বিপুল পরিমাণে ঋণ দেওয়ার কারণে চীন উন্নয়নশীল জগতে অনেক বন্ধু পেয়েছে। যদিও পশ্চিমারা বরাবরই বলে আসছে, এসব দেশের অবকাঠামো খাতে চীন যে ঋণ দিচ্ছে, তাতে এই দেশগুলো ঋণের চক্রে পড়ে যাচ্ছে এবং এই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা তাদের নেই। এমনকি ঋণ পেয়েছে, এমন দেশও সমালোচনা করছে যে ঋণের বোঝা তাদের ঘাড়ে এতটাই চেপে বসেছে যে ওই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা তাদের নেই। দুটি দেশের কথা রয়টার্স এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছে—শ্রীলঙ্কা ও জাম্বিয়া।

তবে এইডডেটার তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চীনের অর্থায়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বদলে গেছে। ২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং উন্নয়নশীল দেশে অবকাঠামো নির্মাণে বেল্ট অ্যান্ড রোড বা অঞ্চল ও পথ উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু সেই উদ্যোগের গতি বেশি দিন ছিল না। ২০১৫ সাল থেকেই অবকাঠামো নির্মাণে চীনের অর্থায়ন কমতে শুরু করে।

২০২১ সালে দেখা গেল, চীনের বিদেশি ঋণের অর্ধেকের বেশি দিয়েছে পিপলস ব্যাংক অব চায়না (পিবিওসি) ও স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব ফরেন এক্সচেঞ্জ (এসএএফই), যার প্রায় পুরোটাই দেওয়া হয়েছে বেইল আউট হিসেবে, অর্থাৎ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য।

এইডডেটা বলছে, এই ঋণ দেওয়ার কারণে চীন এক অপরিচিত ও অস্বস্তিকর পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তারা এখন বিশ্বের বৃহত্তম আনুষ্ঠানিক ঋণদাতা।
এর মধ্য দিয়ে আরেকটি পালাবদল ঘটিয়েছে চীন। সেটা হলো, ঋণের বড় অংশ তারা এখন তাদের নিজস্ব মুদ্রা রেনমিনবি বা ইউয়ানে দিচ্ছে। ২০২০ সালেই এ মুদ্রায় দেওয়া ঋণের পরিমাণ মার্কিন ডলারে দেওয়া ঋণের পরিমাণকে ছাড়িয়ে গেছে।

এইডডেটা বলছে, এত বিপুল পরিমাণ ঋণ ফেরত নেওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে, তা মোকাবিলায় চীন বিদেশি মুদ্রাভিত্তিক এস্ক্রো হিসাব নিয়ন্ত্রণ করছে। এ ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ, এতে চীন ঋণ ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছে, অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা দেশ তার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে বা বিপাকে পড়ার পর ঋণ পরিশোধে সামর্থ্য ফিরে এলে প্রথম যে দেশকে ঋণের অর্থ ফেরত দিতে হবে, তা হলো চীন। এ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে।

এইডডেটার অনুসন্ধানে ১৫টি দেশের তথ্য পাওয়া গেছে, যাদের অনেকগুলো আফ্রিকার দেশ। এস্ক্রো হিসাবে এসব দেশের দেনার পরিমাণ ২০২৩ সালের জুনে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ কোটি ডলার ছিল।

গবেষণা প্রতিবেদনের প্রধান লেখক ছিলেন ব্র্যাড পার্কস বলেন, এ ধরনের সব হিসাব শনাক্ত করা যায়নি। কারণ, এগুলো সাধারণত গোপনীয় রাখা হয়। তিনি উল্লেখ করেন, ৬১৪ বিলিয়ন বা ৬১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের জামানতকৃত ঋণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে এবং চীনের ঋণদাতারা সাধারণত নগদ জামানতই চেয়ে থাকেন। তাই ধারণা করা যায়, সেই এস্ক্রো হিসাবগুলোতে ২৫০ কোটি ডলারের অনেক বেশি অর্থ থাকতে পারে।

চীন বহুপক্ষীয় ঋণদাতা ও পশ্চিমা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে এখন আগের চেয়ে বেশি কাজ করছে। ২০২১ সালে তারা অ-জরুরি খাতে যত ঋণ দিয়েছে, তার অর্ধেকই ছিল সিন্ডিকেটকৃত ঋণ। এ ঋণের আবার ৮০ শতাংশই তারা দিয়েছে পশ্চিমা ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সিন্ডিকেট করে।

একই সঙ্গে চীনের ঋণের গন্তব্যও বদলে গেছে। ২০১৮ সালে তারা মোট ঋণের ৩১ শতাংশ আফ্রিকার দেশগুলোকে দিয়েছিল; ২০২১ সালে যা ১২ শতাংশে নেমে এসেছে। এ সময়ে ইউরোপীয় দেশগুলোকে দেওয়া চীনের ঋণ প্রায় চার গুণ বেড়ে মোট ঋণের ২৩ শতাংশে উঠেছে।

আরেকটি তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২ সালে আফ্রিকার দেশগুলোকে দেওয়া ঋণের অঙ্গীকার ২০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।