বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংকলুটেরা ভিয়েতনামের ট্রুয়ং মাই লান
ভিয়েতনামের ধনকুবের ট্রুয়ং মাই লানের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার ব্যাংক লুটের অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়, এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা। এ ঘটনার তাঁর যে বিচার হয়েছে, তা ভিয়েতনামের সবচেয়ে বড় বিচার।
ভিয়েতনামের সম্পদশালী ব্যবসায়ী ট্রুয়ং মাই লান ৬৮ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক প্রতারণার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। বিচারে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ব্যবসায়ী ট্রুয়ং মাই লানকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। খবর নিউজউইক
লানের এই প্রতারণা কেলেঙ্কারি মালয়েশিয়ার ওয়ানএমডিবি কেলেঙ্কারি এবং স্যাম ব্যাংকম্যান-ফ্রাইডের ৮০০ কোটি ডলার ক্রিপ্টো প্রতারণার ঘটনার চেয়েও বড়। লান দীর্ঘ এক দশক ভিয়েতনামের সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে প্রায় ১২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করেন। ফলে দেশটির ব্যাংক ব্যবস্থায় বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, মোট ৪৪ বিলিয়ন ডলার ব্যাংক থেকে লোপাট করা হয়েছে। ফলে এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা হয়ে উঠেছে।
লানকে দোষী সাব্যস্ত করা হলেও তিনি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছিলেন। এই মাসে তাঁর আপিল খারিজ হয়েছে, ফলে এখন তাঁর হাতে বেশি সময় নেই। বিবিসির সংবাদে বলা হয়েছে, ভিয়েতনামের আইন অনুসারে যদি তিনি তাঁর আত্মসাৎ করা অর্থের ৭৫ শতাংশ পরিশোধ করতে পারেন, তাহলে সাজা কমানো হতে পারে। সে জন্য তিনি ৯ বিলিয়ন বা ৯০০ কোটি ডলার সংগ্রহের চেষ্টা করছেন এবং পুরোনো বন্ধুদের সহায়তা চাচ্ছেন। তাঁর আবেদন ও এই আইনি প্রক্রিয়া এখনো চলমান।
উত্থান ও দারিদ্র্য থেকে সাফল্যের পথে
ট্রুয়ং মাই লানের জীবন শুরু হয় সাধারণ এক পরিবারে। তিনি হো চি মিন শহরের সিনো-ভিয়েতনামি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একসময় মায়ের সঙ্গে বাজারে প্রসাধনী বিক্রি করতেন তিনি। ১৯৮০-এর দশকে ভিয়েতনামে ‘দোই মোই’ অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু হয়, সেই সংস্কারের সুবিধা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। সংস্কার কার্যক্রমের বদৌলতে ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে এবং লান তা যথাযথভাবে কাজে লাগান। একপর্যায়ে তিনি আবাসন ব্যবসা শুরু করেন, এরপর আর তাঁকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
১৯৯২ সালে হংকংয়ের ব্যবসায়ী এরিক চুকে বিয়ে করার পর তাঁর বিত্তবৈভব আরও বৃদ্ধি পায়। এরপরে তিনি ভ্যান থিন ফাট গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন এবং দ্রুত ব্যবসায়িক জগতের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। ২০১১ সালের মধ্যে তিনি হো চি মিন শহরের অন্যতম ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন, যদিও তখন পর্যন্ত কম মানুষই তাঁকে চিনত। ওই সময় তিনটি দুর্বল ব্যাংক একীভূত করে সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংকে একীভূত করায় তিনি সূত্রধরের ভূমিকা পালন করেন। এরপর অবৈধ প্রক্সির মাধ্যমে তিনি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। এরপর তাঁর ধনসম্পদ লাভের পথ সুগম হয়, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায় ও শেষমেশ কুখ্যাতি অর্জন করেন।
ব্যাংক প্রতারণা কেলেঙ্কারি
ট্রুয়ং মাই লানের ব্যাংক প্রতারণার ঘটনা ২০২২ সালে ফাঁস হয়। দীর্ঘ তদন্তে দেখা যায়, তিনি সায়গন কমার্শিয়াল ব্যাংক অপব্যবহার করে এক দশক ধরে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। তিনি একা নন, মোট ৮৬ জন জালিয়াত এই ব্যাংক থেকে ৪৪ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার আত্মসাৎ করেছেন। হাজার হাজার শেল কোম্পানির মাধ্যমে তাঁরা ব্যাংকের এই অর্থ বের করে নিয়ে যান।
এ ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর সায়গান কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে সাময়িকভাবে অর্থ বের করে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। লাখো মানুষের সঞ্চয় বিনষ্ট হয়।
এ ঘটনায় ভিয়েতনামের ব্যাংক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়; চাপ তৈরি হয় সরকারের ওপর। তৈরি হয় আর্থিক সংকট।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভিয়েতনামও দুর্নীতির সমস্যামুক্ত নয়। কিন্তু লানের দুর্নীতির যে পরিসর, তা জানলে মানুষের রীতিমতো ধাক্কা খাওয়ার উপক্রম হয়। দেশটির বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ঘটনায় যে কেবল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়েছে তা নয়; বরং সামগ্রিকভাবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আস্থা বিনষ্ট হয়েছে।
কয়েক দশক ধরে এই অপকর্ম করেছেন লান। এরপর যখন তা ফাঁস হলো, তখন লান সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাতেও কাজ হয়নি। এরপর নিজেকে ভুক্তভোগী হিসেবে দাখিল করার চেষ্টাও করেন তিনি; কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। এখন ভালো কিছু হলেও শেষমেশ বাকি জীবন তাঁকে কারাগারে কাটাতে হবে। একই সঙ্গে এ ঘটনা ভিয়েতনামের দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সফলতা হিসেবে চিহ্নিত হবে। যে ঘটনা থেকে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ শিক্ষা নিতে পারে।