যুক্তরাষ্ট্রে এখন হাজার হাজার মোটেলের মালিক গুজরাটিরা, শুরু কীভাবে
যুক্তরাষ্ট্রে মোটেল ব্যবসায় প্যাটেল নামটি এতই শোনা যায় যে এ নিয়ে অনেকেই মজা করেন। বলা হয়, প্যাটেলরা হোটেল নিয়ে একটি যোগসাজশের ব্যবসা পরিচালনা করেন। এটি পরিচিত ‘প্যাটেল মোটেল কার্টেল’ নামে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমেরিকার মোটেল ব্যবসায়ে গুজরাটি এই ব্যবসায়ীদের আধিপত্য কীভাবে শুরু হলো।
স্টার্টআপটকি ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কঠোর পরিশ্রম, স্মার্ট ব্যবসা ও নিজস্ব সম্প্রদায়ের শক্ত সমর্থন—যুক্তরাষ্ট্রে গুজরাটিদের মোটেল ব্যবসায় সাফল্যের এই হলো চাবিকাঠি। খুব ছোটভাবে শুরু করে আজ তাঁরা হোটেলশিল্পের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। মার্কিন অর্থনীতিতে এই সম্প্রদায় বড় ভূমিকাও রাখছে।
এশিয়ান আমেরিকান হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা ১৯৮৯ সালে। এই সংগঠন ৩৬ হাজারের বেশি হোটেলের প্রতিনিধিত্ব করে। এসব হোটেলের কর্মী সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ১ দশমিক ৫ শতাংশ অবদান রাখে এসব হোটেল। সংগঠনের সদস্যরা প্রতিবছর ৫ হাজার কোটি ডলার খরচ করে, আর তাদের হাতে রয়েছে ১ লাখ কোটি ডলারের সম্পত্তি।
যেভাবে শুরু হলো
ফিরে যেতে হবে ১৯৪২ সালে, যখন কাঞ্জিভাই মানছু দেশাই নতুন সুযোগের সন্ধানে ভারতের গুজরাট ছেড়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে এসে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি আরও দুজন গুজরাটিকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রামেন্টোতে ৩২ রুমের একটি হোটেলের দায়িত্ব নেন। আগে ওই হোটেল চালাতেন একজন জাপানি–আমেরিকান।
কিছুদিন পরই কাঞ্জিভাই দেশাই সান ফ্রান্সিসকোতে চলে যান। সেখানে তিনি হোটেল গোল্ডফিল্ড চালানো শুরু করেন, যেখানে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন আরও কয়েকজন গুজরাটি। ১৯৬৫ সালের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্ট তাকে এ ব্যাপারে খুব সাহায্য করে। এই আইনের বলে আরও অনেক গুজরাটি যুক্তরাষ্ট্রে তাঁদের স্বপ্নের জীবন শুরু করার সুযোগ পান।
এই গুজরাটিরা শুরুতে ভারত থেকে আসেননি, বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গুজরাটিরা মার্কিন মুল্লুকে পাড়ি জমান। বেশির ভাগ এসেছেন উগান্ডা থেকে। একনায়ক ইদি আমিন সে সময় ৫৫ হাজার ভারতীয়কে উগান্ডা ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন গুজরাটি। কেউ কেউ এসেছিলেন ব্রিটেন ও পাকিস্তান থেকেও।
গুজরাটিরা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েন। ১৯৮০–এর দশকের মধ্যে দ্বিতীয় প্রজন্মের গুজরাটিরা তাঁদের বাবা–মায়ের ব্যবসা সম্প্রসারণের কাজে হাত দেন। নতুন নতুন মোটেল কিনে তাঁরা চেইন মোটেলের ব্যবসা ছড়িয়ে দেন।
২০০৭ সালে আমেরিকাতে মোটেলের সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার, এর মধ্যে ২১ হাজারের মালিক ছিল গুজরাটিরা; অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের হসপিটালিটি ব্যবসার ৪২ শতাংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল গুজরাটিদের হাতে।
মোটেল ব্যবসা এবং ভারতীয়–আমেরিকান সম্প্রদায়ে কাঞ্জিভাই মানছু দেশাইয়ের অবদান সব সময়ই স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০০৩ সালে তাঁকে আমেরিকান হোটেল অ্যান্ড লজিং অ্যাসোসিয়েশনের হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ২০০৬ সালে অতিথিসেবার ব্যবসা ও পুরো দেশের জন্য অবদান রাখায় তাঁকে এলিস আইল্যান্ড মেডাল অব অনার দেওয়া হয়।
গুজরাটি মালিকানার হোটেল
শক্তিশালী সম্প্রদায় ও পরিবারের ওপর নির্ভরশীল গুজরাটিরা। একে অপরের সাহায্যে সব সময় তাঁরা এগিয়ে আসেন। কাঞ্জিভাই মানছু দেশাই যখন হোটেল ব্যবসা শুরু করেন, তখন তিনি এই স্লোগান নিয়ে আসেন: ‘আপনি যদি একজন প্যাটেল হন, তাহলে একটি হোটেলের লিজ নেন’।
নিজস্ব সম্প্রদায়ের মানুষদের তাঁরা এতটাই বিশ্বাস করেন যে তাঁরা হ্যান্ডশেক করেই একজন গুজরাটিকে অর্থ ধার দেন। এর জন্য কোনো জামানত লাগে না, কবে টাকা ফেরত দিতে হবে, এ ব্যাপারে কঠোর কোনো শর্ত থাকে না এবং যা খুশি তা–ই দিয়ে দেনা শোধ করতে পারেন। পরিবারের সবার সাহায্য তো নেনই, এমনকি ভারতে থাকা আত্মীয়দের কাছ থেকে বিনা পয়সায় পরামর্শ পান তাঁরা।
মিশিগানের একটি ছোট মোটেলের মালিক গ্যারি প্যাটেল বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন এভাবে, ‘প্যাটেলদের ৪০ শতাংশ একে অপরকে চেনেন। সুতরাং আপনি যখন প্রথম সম্পত্তিটি কিনবেন, দেখবেন কোনো না কোনো প্যাটেল ডাউনপেমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনাকে সাহায্য করছে। কেউ না কেউ আপনার অংশীদার হয়ে যাবেন।’
শক্তিশালী কর্মনৈতিকতা
গুজরাটি মোটেলমালিকেরা একটি কথা মেনে চলেন, ‘অতিথি দেবো ভাবা’, অর্থাৎ অতিথি ভগবান। সে কারণে গুজরাটিরা কঠোর পরিশ্রম করেন, যাতে গ্রাহকেরা কোনো সমস্যার মুখোমুখি না হন। যেকোনো কাজ করতে তাঁরা পিছপা হন না, সে কাজ যতই ছোট হোক না কেন।
ব্যবসা বিষয়টি খুব ভালো বোঝেন গুজরাটিরা। সুযোগ চিহ্নিত করা এবং তার ব্যবহার করার কাজটি তাঁদের চেয়ে ভালো আর কেউ জানেন বলে মনে হয় না। ওয়াশিংটন রাজ্যের স্টারলিংয়ে অবস্থিত একটি হলিডে ইন চালান বিনয় প্যাটেল। দ্বিতীয় প্রজন্মের এই গুজরাটি বলেন, তাঁর বাবা–মা একসময় হোটেল তৈরি করতেন এবং কিছুদিন পর সেটি বিক্রি করে দিতেন। কম খরচে একটি হোটেল বানিয়ে পরে তা বিক্রি করে তাঁরা ভালো লাভ করতেন।