যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে বাণিজ্যবলয় গড়ছে রাশিয়া, ইরান ও চীন
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মধ্যে অভিন্ন একটি বিষয় আছে। সেটা হলো, তাঁরা উভয়ই ব্যক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছেন। খুব একটা ভ্রমণ করেন না তাঁরা, কিন্তু সম্প্রতি উভয়ই চীন সফর করেছেন। পরস্পরের প্রতি তাঁদের ভালো লাগা ও ভালোবাসা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। গত ডিসেম্বরে তাঁরা গাজার যুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করতে ক্রেমলিনে মিলিত হয়েছিলেন। এরপর রাশিয়ার নির্বাচনে গতকাল সোমবার পুতিন আবারও নির্বাচিত হলে রাইসি কালবিলম্ব না করে পুতিনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখা যায়, রাশিয়া, ইরান ও চীনের মধ্যে তেমন একটা বন্ধুত্ব ছিল না। ভেতরে–ভেতরে এরা সাম্রাজ্যবাদী। প্রায়ই এমন হতো যে এরা পরস্পরের প্রতিবেশী দেশগুলোয় হস্তক্ষেপ করত এবং এশিয়ার বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করত। কিন্তু সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে সবকিছু বদলে গেছে।
দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, বারাক ওবামার জমানায় যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিতকরণ–সংক্রান্ত চুক্তি করেছিল, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান। এর দুই বছর পর জো বাইডেন আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন; এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফিলিস্তিনের হামাস ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সমর্থনের জন্য ইরানের বিরুদ্ধে আরও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
২০২২ সালে ইউক্রেনে অভিযান চালানোর পর রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি সেই নিষেধাজ্ঞার গেরো আরও কঠোর হয়েছে। চীনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা লেগেই আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে নিষেধাজ্ঞা বরং আরও জোরালো হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শত্রুর শত্রু বন্ধু হয়—এই দেশ তিনটিও একইভাবে অভিন্ন শত্রুর দ্বারা একত্র হয়েছে। ফলে তাদের পররাষ্ট্রনীতি এখন অভিন্ন; তারা যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যহীন বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। নতুন এই জোটের ভিত্তি হিসেবে তারা মনে করছে, নিজেদের অর্থনৈতিক বন্ধন আরও দৃঢ় করতে হবে।
চীন রাশিয়ার সঙ্গে সীমাহীন বন্ধুত্বের অঙ্গীকার করেছে। এখানেই শেষ নয়, ইরানের সঙ্গে তারা ২৫ বছরের ৪০০ বিলিয়ন বা ৪০ হাজার কোটি ডলারের ‘কৌশলগত অংশীদারি’ ঘোষণা করেছে। চীন ও রাশিয়া ব্রিকসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; এবার ইরানও সদস্যপদ পেয়েছে। এই তিন দেশের মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য বাড়ছে। এখানেই শেষ নয়, তারা শুল্কমুক্তভাবে পণ্য বাণিজ্যের জন্য ব্লক গঠনের পরিকল্পনা করছে। সেই সঙ্গে অর্থ পরিশোধের নতুন ব্যবস্থা ও পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রিত বাণিজ্যপথ এড়িয়ে নতুন পথে বাণিজ্য করার পরিকল্পনা করছে।
মার্কিনিদের কাছে এসব পরিকল্পনা দুঃস্বপ্নের মতো। এ রকম পশ্চিমবিরোধী অক্ষ গঠিত হলে তাদের শত্রুরা নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর সুযোগ পাবে। আগামী ৫ থেকে ১০ বছরে এই দেশগুলো ঠিক কোথায় যাবে, সেটাই এখন তাদের বড় প্রশ্ন।
জ্বালানি কিনছে চীন
চীন সব সময় রাশিয়া ও ইরানের পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্রেতা। তবে এই দেশ দুটি একই সঙ্গে ইউরোপ ও আমেরিকায় বিপুল পরিমাণে তেল বিক্রি করত; ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে ইউরোপের সঙ্গে তাদের তেলের বাণিজ্য ছিল চাঙা। কিন্তু ইউরোপ রাশিয়া ও ইরানের তেল নেওয়া বন্ধ করার কারণে চীন রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় ব্যারেল ব্যারেল তেল কিনছে। যুদ্ধের আগে রাশিয়ার বন্দর দিয়ে চীন দিনে এক লাখ ব্যারেল তেল কিনত; এখন তা দিনে পাঁচ লাখ ব্যারেলে উন্নীত হয়েছে। ডিসেম্বরে রাশিয়া থেকে চীন দৈনিক ২২ লাখ ব্যারেল পর্যন্ত তেল নিয়েছে, যা চীনের মোট চাহিদার ১৯ শতাংশ। দুই বছর আগে চীন রাশিয়া থেকে দিনে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ ব্যারেল তেল কিনত।
একইভাবে গত বছরের শেষ ভাগে ইরান থেকে চীন দৈনিক গড়ে ১০ লাখ ব্যারেল তেল কিনেছে—২০২১ সালের তুলনায় যা ১৫০ শতাংশ বেশি।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার একটি দিক হলো, জি৭ দেশগুলো ছাড়া যে কেউ রাশিয়ার তেল কিনতে পারে। কিন্তু ইরানের ওপর আবার তথাকথিত দ্বিতীয় স্তরের নিষেধাজ্ঞা আছে। সেটা হলো, জি৭–ভুক্ত দেশগুলোর বাইরের দেশগুলোও এই নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত। কিন্তু ২০২২ সাল থেকে বাইডেন প্রশাসন এই নিয়ম প্রয়োগে শিথিল। তারা মনে করছে, নিয়ম ভঙ্গ হলে যদি তেলের দাম কমে, তাহলে খারাপ কিছু নয়। ফলাফল হলো, ইরানের কাছ থেকে চীনের তেল কেনা বেড়ে যাওয়া।
কিন্তু চীনের বড় বড় রাষ্ট্রায়ত্ত তেল পরিশোধনাগারগুলো এই তেল আমদানি করছে না; বরং ছোট ছোট পরিশোধনাগারগুলো এই তেল আমদানি করছে, দেশের বাইরে যাদের অস্তিত্ব নেই। বড় রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো একসময় নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় তারা ইরান থেকে তেল আমদানি করছে না। অন্যদিকে চীন রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় গ্যাসও পাচ্ছে। ২০২২ সালের ইউক্রেন অভিযান শুরু হওয়ার পর ‘পাওয়ার অব সাইবেরিয়া’ হিসেবে পরিচিত পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়ার গ্যাস আমদানি দ্বিগুণ করেছে চীন।
চীনের কাছে তেল-গ্যাস বিক্রি না করে ইরান ও রাশিয়ার তেমন উপায়ও নেই। চীনের ওপর কেবল পশ্চিমা প্রযুক্তি আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আছে। তাদের ওপর আর্থিক বা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা নেই। ফলে তারা সব দেশের কাছ থেকেই তেল কিনতে পারে, দর-কষাকষির সময় যা তাদের অনুকূলে থাকে।
বিশ্ববাজারে প্রচলিত দামের তুলনায় রাশিয়া ও ইরানের কাছ থেকে চীন ব্যারেলপ্রতি ১৫ থেকে ৩০ ডলার কমে তেল কেনে। এরপর সেই সস্তা হাইড্রোকার্বন প্রক্রিয়াজাত করে তারা উচ্চ মূল্যের পণ্য তৈরি করে। অর্থাৎ তারা মূল্য সংযোজন করে। ২০১৯ সালের পর চীনের পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের যে বিকাশ ঘটেছে, তা বিশ্বের বাকি দেশগুলোর সম্মিলিত দক্ষতা বৃদ্ধির তুলনায় বেশি।
বাণিজ্য বাড়ছে
দ্য ইকোনমিস্টের সংবাদে বলা হয়েছে, রাশিয়ার কাছ থেকে চীনের যেমন তেল কেনা বেড়েছে, তেমনি রাশিয়াতেও চীনের রপ্তানি বেড়েছে। কোভিড-১৯-এর কারণে চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তারা জুতা বা টি-শার্ট রপ্তানির বদলে উচ্চ মূল্যের যন্ত্রপাতি রপ্তানিতে মনোযোগ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া তাদের পরীক্ষণ ভূমি বা বাজার। গত বছর চীনের গাড়ি রপ্তানিতে ইউরোপ নয়, শীর্ষ গন্তব্য ছিল রাশিয়া।
রাশিয়া বিশেষ করে বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানি বৃদ্ধি করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে দেশটি যত পেট্রলভিত্তিক গাড়ি আমদানি করত, গত বছর আমদানি করেছে তার তিন গুণ।
তবে কাঁচামালের অভাবে ইরানের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যদিও দেশটির উৎপাদন খাত পেট্রোলিয়াম খাতের মতোই বড়। চীনের কাছ থেকে দেশটি এখনো তেমন একটা আমদানি করছে না। কিছু যন্ত্রপাতি আর মাসে ৩০০ থেকে ৫০০ গাড়ি, যদিও পার্শ্ববর্তী দেশ ইরাকে চীন প্রতি মাসে তিন হাজারের মতো গাড়ি রপ্তানি করে। চীনের বড় রপ্তানিকারকেরা যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার সাহস পাচ্ছে না বলে সংবাদে বলা হয়েছে।
তাত্ত্বিকভাবে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়লে ইরান লাভবান হবে। উভয় দেশের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাণিজ্য আছে। ২০২২ সাল থেকে ইরান রাশিয়াকে ড্রোন ও অস্ত্র সরবরাহ করছে, যে অস্ত্র ইউক্রেনে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর এই প্রথম ইরান কোনো অমুসলিম দেশকে সামরিক সরঞ্জাম দিল। চলতি বছরের শুরুর দিকে ইরান রাশিয়াকে ট্যাংকারযোগে ১০ লাখ ব্যারেল তেল সরবরাহ করেছে; এটাও ছিল প্রথম। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে এই দেশগুলোর মধ্যে বন্ধন গভীরতর হওয়া দুরূহ হয়ে উঠছে।
তবে মূলকথা হলো, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নীতির কারণে রাশিয়া, ইরান ও চীনের সম্পর্ক গভীর হচ্ছে। যদিও তারা নিজেদের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য করতে পারবে, তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এখনো অনেক বিষয়ের সমাধান তাদের করতে হবে। কিন্তু তাদের সম্পর্ক যেদিকে যাচ্ছে, তাতে এসব সমস্যা তারা হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারবে।