আর্জেন্টিনায় কষ্টের জীবনে উচ্ছ্বাস ফেরাল মেসিরা
একে তো রাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে চলছে আন্দোলন, তার ওপর ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির চাপ। সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো নয়, ঋণভারে জর্জরিত। বিশেষ করে বাজারে গেলেই নাভিশ্বাস ওঠে সাধারণ ক্রেতাদের। যেকোনো কিছু কেনার আগে দশবার ভাবতে হয় তাঁদের। কারণ বার্ষিক হিসাবে মূল্যস্ফীতি বেড়ে এরই মধ্যে ৮৮ শতাংশে উঠে গেছে। অর্থাৎ এক বছর আগে যে পণ্যের দাম ছিল ১০০ পেসো (স্থানীয় মুদ্রা), সেটি এখন ১৮৮ পেসো। দুর্নীতির মামলায় গত মঙ্গলবার তো বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট (যিনি আবার সাবেক প্রেসিডেন্টও) ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ দে কির্চনারের ছয় বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতিতেই দেশটির ফুটবলাররা গত রাতে বিশ্বকাপ ফুটবলে অবিস্মরণীয় এক জয় পেয়েছে। কোয়ার্টার ফাইনালের খেলায় তাঁরা টাইব্রেকারে নেদারল্যান্ডসকে ৪-৩ ব্যবধানে হারিয়ে উঠে গেছেন সেমিফাইনালে। বুঝতেই পারছেন, মেসিদের দেশ আর্জেন্টিনার কথা বলা হচ্ছে। এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম ম্যাচের পরাজয় খানিক ধরিয়ে দিলেও পরবর্তী ম্যাচগুলোয় একের পর এক জয়ের সুবাদে দেশটি এখন সেমিফাইনালে উঠে গেছে। বদৌলতে ভোক্তারা ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির চাপসহ দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা ভুলে; রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মীরা রাজপথ ছেড়ে ঘরে, বারে, হোটেলে, রেস্তোরাঁয় কিংবা উন্মুক্ত স্থানে বড় পর্দায় আর্জেন্টিনা জাতীয় ফুটবল দলের খেলা প্রাণভরে উপভোগ করছেন। দলের জয়ের পর রাস্তায় নেমে উদ্যাপন করছেন।
অনেক আর্জেন্টাইনের মতো রাজধানী বুয়েনস আইরেসের বাসিন্দা নাটালি অ্যাকোস্তাও আশা করছেন, দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতা শিগগিরই কেটে যাবে। যদিও তিনি এখন রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, উচ্চ মূল্যে মুদিখানা থেকে খাদ্যপণ্য কিনতে হচ্ছে। তবে এ রকম সঙ্গিন পরিস্থিতিকেও উপেক্ষা করার চেষ্টা করছেন নাটালি। কারণ একটাই, ফুটবল।
একটি কারখানার কর্মী নাটালি অ্যাকোস্তা বলেন, ‘সকার (ফুটবল) আমাদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো কিছুটা ভুলে যেতে সাহায্য করে। আমাদেরও সমস্যাগুলো ভুলে যেতে হবে। আর্জেন্টিনা যদি সব জিতে যায়, তাতে আমি হয়তো পুরো ভালো থাকতে পারব না। তবে আমরা অন্তত খুশি তো হতে পারব।’
বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আরও সরকারি সাহায্যের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন। তাঁরা এখন আর্জেন্টিনার খেলার দিনে রাস্তা অবরোধের কর্মসূচি ছেড়ে ঘরে অবস্থান করেন, টিভিতে ম্যাচ দেখেন। খেলার সময় অফিসের কর্মীরা ছুটি নেন, ব্যস্ত পার্কগুলো ফাঁকা হয়ে যায়। স্কুলও শিশুদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
আর্জেন্টিনার বেকার নাগরিকদের একটি সংস্থার প্রধান এদুয়ার্দো বেলিবোনি বরেন, ‘খেলা চলাকালে আমরা প্রতিবাদ করতে যাই না।’
এদিকে ‘আর্জেন্টিনার সমাজে ফুটবলের ভূমিকা’ শীর্ষক বইয়ের লেখক এদুয়ার্দো সাচেরি বলেন, ‘সব মনোযোগ বিশ্বকাপের দিকে। আমি বলব, সকারই একমাত্র জিনিস, যা আমাদের একত্র করে।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানবন্দরের এক নিরাপত্তা প্রহরী এক যাত্রীর বোর্ডিং পাস হাতে রেখে আর্জেন্টিনার গোল উদযাপনের জন্য ছুটে যান।
জাতীয় দলের ক্রমাগত জয়ের ফলে আর্জেন্টিনার নাগরিকদের কাতারে আগমন বাড়ছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান সংস্থা অ্যারোলিনাস আর্জেন্টিনাস সম্প্রতি বুয়েনস আইরেস থেকে দোহা পর্যন্ত ২০ ঘণ্টার উড়ান চালু করেছে। টিকিটও বিক্রি হচ্ছে দেদার।
ক্যাথলিক ইউনিভার্সিটি অব আর্জেন্টিনার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী গত অক্টোবর মাসে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি ৮৮ শতাংশে ওঠায় সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন কমে গেছে। মূল্যস্ফীতির এই হার এক প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। অন্য এক হিসাবমতে, বর্তমানে বিশ্বে মাত্র ছয়টি দেশে আর্জেন্টিনার চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি। দেশগুলো হচ্ছে জিম্বাবুয়ে (২৬৯%), লেবানন (১৬২%), ভেনিজুয়েলা (১৫৬%), সিরিয়া (১৩৯%) ও সুদান (১০৩%)। এ ছাড়া আর্জেন্টিনায় দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪৩ শতাংশে উঠেছে, যা পাঁচ বছর আগে ছিল ২৮ শতাংশ।
ফুটবলপ্রিয় জাতি হিসেবে অতি সাধারণ আর্জেন্টাইন নাগরিকদের মধ্যেও বিশ্বকাপ নিয়ে উত্সাহ আগের মতোই শক্তিশালী। আর্জেন্টিনার ফুটবল জার্সি পরে রাস্তায় রুমাল বিক্রি করছিল নিকোলাস ভিউব্লিওনেট নামের এক কিশোর। এক প্রশ্নের জবাবে সে জানায়, অর্থনীতির উন্নতির চেয়ে আর্জেন্টিনাকে এই বছরের বিশ্বকাপ জিততে দেখাটাকেই সে বেশি পছন্দ করবে। তার বক্তব্য, ‘কোনো সন্দেহ নেই যে আমি আর্জেন্টিনাকে জিততে দেখতেই পছন্দ করব। একটু সুখ পাওয়াই ভালো।’
নিকোলাস ভিউব্লিওনেটের কথাই হয়তো ঠিক, আর্জেন্টিনার মতো দেশে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার স্বল্পস্থায়ী হয় এবং তা সংকটের পুনরাবৃত্তি ঘটায়। তা না হলে ১৯৫০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আর্জেন্টিনাকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ২০ বারের বেশি সহায়তা নিতে হবে কেন? সূত্র: দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।